শ্রীলঙ্কা কেন আইসিসি মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ ২০২৫-এর ম্যাচ আয়োজন করছে?

কাশ্মীর ইস্যু ও সীমান্ত সংঘর্ষে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি, ঝুঁকির আশঙ্কায় আইসিসির বিকল্প সিদ্ধান্ত

বিশেষ প্রতিবেদন: ২০২৫ সালের আইসিসি (ICC) মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রধান আয়োজক দেশ ভারত হলেও, পাকিস্তানের ম্যাচগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে শ্রীলঙ্কায়। কারণ—ভারত ও পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক উত্তেজনা, সাম্প্রতিক সামরিক সংঘাত এবং নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কা। এই বাস্তবতায় আইসিসি পাকিস্তানের ম্যাচগুলো নিরপেক্ষ ভেন্যু হিসেবে শ্রীলঙ্কার কলম্বোতে স্থানান্তর করেছে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেটীয় সম্পর্ক বহু বছর ধরেই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে সীমিত। ২০১২ সালের পর থেকে দুই দেশ দ্বিপাক্ষিক সিরিজে মুখোমুখি হয়নি। এ ছাড়া কাশ্মীর ইস্যু, সীমান্ত সংঘর্ষ, এবং সন্ত্রাসবাদ নিয়ে পারস্পরিক অভিযোগ দুই দেশের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলেছে। ২০২৫ সালের মে মাসে চার দিনের সামরিক সংঘাতে এই উত্তেজনা চরমে ওঠে। ফলে আইসিসি মনে করে, পাকিস্তান দলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের ম্যাচ ভারতে আয়োজন করা ঝুঁকিপূর্ণ।

দুই দলের অধিনায়কত্বে হারমানপ্রীত কৌর ও ফাতিমা সানা

আসন্ন নারী এশিয়া কাপ ২০২৫-কে সামনে রেখে ভারত ও পাকিস্তান তাদের দল ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের নেতৃত্বে থাকছেন ফাতিমা সানা, সহ-অধিনায়ক মুনিবা আলি সিদ্দিকী। অন্যদিকে, ভারতের নেতৃত্বে থাকছেন হারমানপ্রীত কৌর, সহ-অধিনায়ক স্মৃতি মন্ধানা।

পাকিস্তান নারী দল

ফাতিমা সানা (অধিনায়ক), মুনিবা আলি সিদ্দিকী (সহ-অধিনায়ক), আলিয়া রিয়াজ, ডায়ানা বেইগ, আইমান ফাতিমা, নাশরা সান্ধু, নাতালিয়া পারভেজ, ওমাইমা সোহেল, রমিন শামীম, সাদাফ শামাস, সাদিয়া ইকবাল, শাওয়াল জুলফিকার, সিদরা আমিন, সিদরা নবাজ, সৈয়দা আরুব শাহ।

ভারত নারী দল

হারমানপ্রীত কৌর (অধিনায়ক), স্মৃতি মন্ধানা (সহ-অধিনায়ক), প্রতিকা রাওয়াল, হারলিন দেওল, দীপ্তি শর্মা, জেমিমাহ রদ্রিগেজ, রেনুকা সিং ঠাকুর, অরুন্ধতী রেড্ডি, ঋচা ঘোষ (উইকেটরক্ষক), ক্রান্তি গৌড়, আমনজোত কৌর, রাধা যাদব, শ্রী চরনি, যাস্তিকা ভাটিয়া (উইকেটরক্ষক), স্নেহ রানা।

দুই দলের স্কোয়াডে অভিজ্ঞ ও তরুণ খেলোয়াড়দের সমন্বয় দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের অলরাউন্ডার দীপ্তি শর্মা ও পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার ডায়ানা বেইগ আসন্ন আসরে নজর কাড়বেন বলে প্রত্যাশা ক্রিকেট বিশ্লেষকদের।

শ্রীলঙ্কাকে বেছে নেওয়ার পেছনে রয়েছে বেশ কিছু বাস্তব কারণ। প্রথমত, শ্রীলঙ্কা ভারতের নিকটবর্তী হওয়ায় দল ও কর্মকর্তাদের যাতায়াত সহজ এবং লজিস্টিক সুবিধা বেশি। দ্বিতীয়ত, দেশটির রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা—ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে শ্রীলঙ্কা। তৃতীয়ত, কলম্বো, পাল্লেকেলে ও হাম্বানটোটা—এই তিনটি আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম বিশ্বমানের আয়োজনে সক্ষম। এছাড়া, শ্রীলঙ্কা অতীতে ১৯৯৬ ও ২০১১ সালের পুরুষদের বিশ্বকাপ এবং ২০০২ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি সফলভাবে আয়োজন করেছে।

২০২৫ সালের মহিলা বিশ্বকাপের ম্যাচগুলো ভারত ও শ্রীলঙ্কা মিলিয়ে চারটি শহরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ভারতের তিনটি ভেন্যু হলো গুয়াহাটি, নাভি মুম্বাই ও ইন্দোর; আর শ্রীলঙ্কায় একমাত্র ভেন্যু কলম্বোর আর. প্রেমদাসা স্টেডিয়াম। পাকিস্তানের সব গ্রুপ পর্বের ম্যাচ এখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২ অক্টোবর বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তান ম্যাচে বাংলাদেশ ৭ উইকেটে জয় পায়। আজ ৫ অক্টোবর কলম্বোতেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার হাই-ভোল্টেজ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যা টুর্নামেন্টের অন্যতম আকর্ষণ।

আইসিসির এই বিশেষ বিন্যাস অনুযায়ী, পাকিস্তান যদি সেমিফাইনাল বা ফাইনালে উঠে, তবে সেসব ম্যাচও কলম্বোতেই আয়োজন করা হবে। এর মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচগুলোকে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভেন্যুতে রাখা হচ্ছে, যাতে কোনো রাজনৈতিক জটিলতা না সৃষ্টি হয়।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুধু ক্রিকেট নয়, সামগ্রিকভাবে দুই দেশের সম্পর্কেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। ভারত অভিযোগ করে, পাকিস্তান সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদে মদদ দিচ্ছে; অন্যদিকে পাকিস্তান বলে, ভারত কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এই অবস্থায় ক্রীড়ার মাধ্যমে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই শ্রীলঙ্কার নিরপেক্ষ অবস্থান দুই পক্ষের জন্যই গ্রহণযোগ্য হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিও এই আয়োজন থেকে উপকৃত হচ্ছে। কলম্বোতে আয়োজিত ম্যাচগুলোতে বিদেশি পর্যটক ও দর্শকদের উপস্থিতি হোটেল, পরিবহন ও বাণিজ্য খাতে প্রবৃদ্ধি আনছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্রিকেট বিশ্বকাপ তাদের জন্য অর্থনৈতিক ‘বোনাস সিজন’। একই সঙ্গে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ডও (SLC) আইসিসির কাছ থেকে আয় ভাগ পাবে, যা তাদের ক্রিকেট অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়ক হবে।

ক্রিকেটীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আজকের ভারত-পাকিস্তান ম্যাচটি টুর্নামেন্টের সবচেয়ে আলোচিত খেলা। ভারতের পক্ষে স্মৃতি মান্ধানা, হরমনপ্রীত কৌর ও রিচা ঘোষ আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। অন্যদিকে পাকিস্তানের ভরসা তাদের স্পিন আক্রমণ, বিশেষ করে নাশরা সান্ধু ও সাদিয়া ইকবালের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে। কলম্বোর আর্দ্র ও ধীর উইকেট পাকিস্তান বোলারদের অনুকূলে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকদের মত।

শ্রীলঙ্কার নিরপেক্ষ ভূমিকা কেবল ক্রিকেট নয়, দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক ভারসাম্যেরও প্রতীক হয়ে উঠেছে। ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যেও ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখার একটি সফল উদাহরণ এটি। আইসিসি জানিয়েছে, ভবিষ্যতের টুর্নামেন্টগুলোতেও নিরপেক্ষ ভেন্যুর এই মডেল প্রয়োগ করা হতে পারে, বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের ক্ষেত্রে।

এই আয়োজনের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কা শুধু নিরপেক্ষ ভেন্যু নয়, বরং দক্ষিণ এশীয় ক্রিকেট ঐক্যের প্রতীক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। দেশটির জনগণ ও সরকার নারী ক্রিকেটকে ঘিরে ব্যাপক উৎসাহ দেখাচ্ছে। স্কুল ও একাডেমিক পর্যায়ে মেয়েদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নতুনভাবে শুরু হয়েছে, যা ভবিষ্যতে মহিলা ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কাকে শক্তিশালী করে তুলতে পারে।

সব মিলিয়ে, আইসিসির এই সিদ্ধান্ত শুধু নিরাপত্তা বা রাজনীতি নয়, ক্রিকেটের বৈশ্বিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। শ্রীলঙ্কা একদিকে দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার প্রতীক, অন্যদিকে ক্রিকেট কূটনীতির নতুন কেন্দ্রবিন্দু।

আজ কলম্বোর আর. প্রেমদাসা স্টেডিয়ামে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচকে ঘিরে কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর দৃষ্টি, যা প্রমাণ করে—ক্রিকেট সীমান্ত পেরিয়ে এক নতুন সেতুবন্ধন তৈরি করতে পারে।