বান্দরবানে প্রবরণা পূর্ণিমা উৎসব: পাহাড়জুড়ে শান্তি ও ঐক্যের বার্তা

সীমান্ত অশান্তির প্রেক্ষাপটে প্রবরণা পূর্ণিমা শান্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে

বান্দরবান প্রতিনিধি: বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব প্রবরণা পূর্ণিমা উপলক্ষে বান্দরবান জেলাজুড়ে নেমে এসেছে উৎসবের আমেজ। পাহাড়ি জনপদটি আজ রঙ, আলো ও ভক্তির আবহে সেজে উঠেছে।

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি বর্ষাবাসের সমাপ্তি ও সংঘজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বের প্রতীক।

রোববার, ৫ অক্টোবর থেকে ৭ অক্টোবর পর্যন্ত বান্দরবানে পালিত হবে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের প্রবারনা উৎসব।

প্রবরণা পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মে “ক্ষমা ও ঐক্যের দিন” হিসেবে পরিচিত। আশ্বিন মাসের এই পূর্ণিমা তিথিতে ভিক্ষুরা তিন মাসের বর্ষাবাস শেষে একে অপরের কাছে ভুল-ত্রুটির জন্য ক্ষমা চান। এ দিন ধর্মীয় শুদ্ধতা, ধ্যান এবং ভ্রাতৃত্ববোধের নবায়ন ঘটে। ভিক্ষুরা সংঘের মধ্যে ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রার্থনা করেন।

বান্দরবানের প্রধান বৌদ্ধবিহারগুলো—রাজবিহার, উজানীপাড়া বৌদ্ধ বিহার, এবং ধ্যানগঞ্জ বৌদ্ধ বিহারে সকাল থেকেই শুরু হয় ধর্মীয় সূত্র পাঠ ও ধ্যান। ভিক্ষুদের নেতৃত্বে প্রবরণা সংঘের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়।

ভক্তরা ফুল, ধূপ, মোমবাতি ও দানসামগ্রী নিয়ে ভক্তিপূর্ণ পরিবেশে অংশ নেন। বৌদ্ধ তরুণ-তরুণীরাও মন্দিরে গিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনা করেন পরিবারের মঙ্গল ও সমাজের শান্তির জন্য।

প্রদীপ প্রজ্জ্বলনে পাহাড় আলোকিত

সন্ধ্যা নামতেই বান্দরবান শহর ও আশপাশের এলাকায় হাজারো প্রদীপে জ্বলে ওঠে পাহাড়ি রাত। মন্দির, রাস্তা ও বাড়িঘর সাজানো হয় রঙিন আলোয়। প্রদীপের এই আলোকসজ্জা শান্তি, জ্ঞান ও মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

স্থানীয়রা জানান, “প্রদীপ জ্বালানো মানে শুধু উৎসব নয়, এটি আমাদের আত্মার আলোকিত হওয়ার প্রতীক।”

সাংস্কৃতিক উৎসব ও ঐক্যের বার্তা

দিনব্যাপী ধর্মীয় আচার শেষে সন্ধ্যায় বান্দরবান রাজবিহার প্রাঙ্গণ ও রাজার মাঠে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মারমা, ত্রিপুরা ও চাকমা শিল্পীরা পরিবেশন করেন ঐতিহ্যবাহী নাচ, গান ও সঙ্গীত। এছাড়া স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেয় ধর্মীয় নাটিকা ও আলোচনায়, যেখানে বৌদ্ধ জীবনদর্শন ও শান্তির বার্তা তুলে ধরা হয়।

প্রবরণা পূর্ণিমা উপলক্ষে বান্দরবানে পাহাড়ি-বাঙালি সব সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে সৃষ্টি হয়েছে ঐক্যের দৃশ্য। স্থানীয় প্রশাসন, বৌদ্ধ ভিক্ষু ও সম্প্রদায় নেতারা শান্তি ও সহাবস্থানের আহ্বান জানিয়েছেন।

মারমা সম্প্রদায়ের এক প্রবীণ নেতা বলেন, “এই দিন আমাদের ঐক্যের প্রতীক। আমরা একে অপরের ভুল ক্ষমা করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার শপথ নিই।”

নিরাপত্তা ও প্রশাসনের প্রস্তুতি

বান্দরবান জেলা প্রশাসন ও পুলিশ উৎসবের নিরাপত্তায় নেয় কঠোর ব্যবস্থা। সব মন্দির, বিহার ও জনসমাগম এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার উৎসবস্থলগুলো ঘুরে দেখেন এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

বান্দরবানের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

বান্দরবান বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পাহাড়ি জেলা, যেখানে মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, ম্রোসহ বহু জাতিগোষ্ঠী সহাবস্থানে বসবাস করে। এখানে বৌদ্ধ ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি শতাব্দী ধরে বিকশিত হয়েছে। প্রবরণা পূর্ণিমা সেই ঐতিহ্যের একটি উজ্জ্বল প্রতীক।

উৎসবের ঝলক অনলাইনে

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বান্দরবানের প্রবরণা পূর্ণিমার উৎসবমুখর ছবি ও ভিডিও। এক্স (X) ও ফেসবুকে স্থানীয়রা মন্দিরের আলোকসজ্জা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মুহূর্তগুলো শেয়ার ক‌রে‌ছেন।

প্রবরণা পূর্ণিমা আজ শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং শান্তি, ক্ষমা ও ঐক্যের এক চিরন্তন বার্তা।

সাম্প্রতিক সীমান্ত অশান্তির প্রেক্ষাপটে বান্দরবানের এই উৎসব দেখিয়েছে—আলো অন্ধকারকে জয় করবেই। এমন উৎসবই পাহাড়ি জনপদে এনে দেয় পারস্পরিক ভালোবাসা, সম্মান ও মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।