বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য
রোহিঙ্গা মুসলিম এবং মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘে উচ্চ-পর্যায়ের সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য।
টুইট প্রতিবেদক: জাতিসংঘের সদর দপ্তরে রোহিঙ্গা মুসলিম এবং মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত উচ্চ-পর্যায়ের সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা প্রদান করেছেন। তিনি রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান এবং এই সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য সাতটি নির্দিষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
সংকটের প্রেক্ষাপট
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তৃতায় উল্লেখ করেন যে, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা শুরু হওয়ার আট বছর পরও এই সংকট অমীমাংসিত রয়েছে। তিনি বলেন, “এই সংকট মিয়ানমারে উৎপন্ন হয়েছে এবং এর সমাধানও মিয়ানমারেই নিহিত।” তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি মিয়ানমার সরকার এবং আরাকান আর্মির উপর কার্যকর চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানান, যাতে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন বন্ধ করে তাদের দ্রুত রাখাইনে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে মিয়ানমারের বৃহত্তর সংস্কারের সাথে জড়িয়ে ফেলা উচিত নয়।
বাংলাদেশের ভূমিকা এবং চ্যালেঞ্জ
প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশকে এই সংকটের “শিকার” হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশকে বিপুল আর্থিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত বোঝা বহন করতে হচ্ছে। রাখাইন থেকে মাদক পাচারসহ অপরাধমূলক কার্যক্রম বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক চ্যালেঞ্জ, যেমন বেকারত্ব এবং দারিদ্র্যের কারণে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ দেওয়া সম্ভব নয়।
প্রত্যাবাসনের জরুরি প্রয়োজনীয়তা
তিনি জোর দিয়ে বলেন, আন্তর্জাতিক তহবিলের ঘাটতির কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনই এই সংকটের একমাত্র শান্তিপূর্ণ সমাধান। তিনি উল্লেখ করেন, রোহিঙ্গারা বারবার তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে, যারা সাম্প্রতিক সংঘাতের কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, তাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করা উচিত। তিনি বলেন, প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সুরক্ষার তুলনায় অনেক কম সম্পদের প্রয়োজন হবে।
সাতটি প্রস্তাব
সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি নিম্নলিখিত সাতটি পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব দেন;
১. নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের রোডম্যাপ: রাখাইনে যুক্তিসঙ্গত স্থিতিশীলতার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য একটি বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রণয়ন করা।
২. মিয়ানমার ও আরাকান আর্মির উপর চাপ প্রয়োগ: রোহিঙ্গাদের উপর সহিংসতা বন্ধ করতে এবং তাদের টেকসই প্রত্যাবাসন শুরু করতে মিয়ানমার সরকার এবং আরাকান আর্মির উপর কার্যকর চাপ প্রয়োগ করা, বিশেষ করে সম্প্রতি আগত এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য।
৩. রাখাইনের স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক উপস্থিতি: রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড় করা এবং স্থিতিশীলতা পর্যবেক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক বেসামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা।
৪. আস্থা সৃষ্টির উদ্যোগ: রাখাইন সমাজ ও শাসনব্যবস্থায় রোহিঙ্গাদের টেকসই একীভূতকরণের জন্য আস্থা সৃষ্টির ব্যবস্থা গ্রহণ।
৫. তহবিল সংগ্রহ: জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের জন্য দাতাদের অবদান জোগাড় করে সম্পূর্ণ তহবিল নিশ্চিত করা।
৬. জবাবদিহিতা ও পুনরুদ্ধারমূলক ন্যায়বিচার: রোহিঙ্গাদের উপর সংঘটিত অপরাধের জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং পুনরুদ্ধারমূলক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।
৭. মাদক অর্থনীতি ও সীমান্তবর্তী অপরাধ দমন: মাদক অর্থনীতি ভেঙে ফেলা এবং সীমান্তবর্তী অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তৃতার সমাপ্তিতে বলেন, “বিশ্ব রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারে না।” তিনি এই সংকটের চূড়ান্ত সমাধানের জন্য একযোগে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আহ্বান জানান এবং এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের পূর্ণ সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দেন।
এই সম্মেলন রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তৃতা এই সংকটের জরুরি সমাধান এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
তাঁর প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হলে এই দীর্ঘস্থায়ী মানবিক সংকটের সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জিত হতে পারে।