মাদাগাস্কারে জেন-জি আন্দোলনের চাপ: সরকার ভেঙে দিলেন প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনা

জেন জি’র আগুনে মাদাগাস্কারে প্রেসিডেন্ট: বিদ্যুৎ-পানি সংকট: যুবকদের বিক্ষোভে ২২ জন নিহত, সরকার ভেঙে দিয়েছে প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনা।

বিশ্ব ডেস্ক: মাদাগাস্কারের রাজধানী অ্যান্টানানারিভোসহ দেশের আটটি শহরে বিদ্যুৎ ও পানির সংকট নিয়ে শুরু হওয়া যুবকদের নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ টানা চতুর্থ দিনে সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। জাতিসংঘের মতে, এতে অন্তত ২২ জন নিহত এবং ১০০-এর বেশি আহত হয়েছেন।

এই ঘটনায় প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোয়েলিনা সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) তার পুরো সরকার ভেঙে দিয়েছেন এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের জন্য তিন দিনের মধ্যে আবেদন আহ্বান জানিয়েছেন। এটি রাজোয়েলিনার ২০২৩ সালের পুনর্নির্বাচনের পর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট।

প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনা বলেন, “আমি ক্ষোভ, দুঃখ এবং বিদ্যুৎ-পানি সমস্যার কষ্ট বুঝি। আমি ডাক শুনেছি, কষ্ট অনুভব করেছি।”

ভলকার তুর্ক বলেন: “নিরাপত্তা বাহিনীর অসমানুপাতিক বলপ্রয়োগে আমি হতবাক।”

সংকটের কারণ

মাদাগাস্কার, আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত এই দ্বীপরাষ্ট্র, বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে জনসংখ্যার প্রায় ৭৫% (প্রায় ৩ কোটি মানুষ) দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দীর্ঘদিন ধরে দেশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা (দৈনিক ১২ ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং) এবং পানির অভাব সাধারণ মানুষের জীবনকে যন্ত্রণাদায়ক করে তুলেছে। এই সমস্যাগুলো অর্থনৈতিক অবনতি, দুর্নীতি এবং সরকারের অদক্ষতার ফল, যা জনগণের ক্ষোভকে উস্কে দিয়েছে।

বিক্ষোভকারীরা এই সংকটকে “জীবনযাপনের অধিকার” হরণ হিসেবে দেখছেন এবং স্লোগান দিচ্ছেন, “আমরা বেঁচে থাকতে চাই, শুধু টিকে থাকতে নয়।”

বিক্ষোভের সূত্র

বিক্ষোভ শুরু হয় গত বৃহস্পতিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) থেকে, প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে। এটি মূলত ‘জেন জেড’ (যুবকদের) নেতৃত্বাধীন, যারা ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় সমন্বয় করে। রাজধানী অ্যান্টানারিভোর প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয়ে এটি শহরের কেন্দ্রে মার্চে রূপ নেয়। বিক্ষোভকারীরা জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে এবং প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ করেন। কেনিয়া, নেপাল এবং মরক্কোর যুব-বিক্ষোভ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা নেপালের পতাকা-জাতীয় ডিজাইনের পতাকা বহন করেছেন।

প্রথমে শক্তি মন্ত্রীর পদত্যাগ, পরে পুরো সরকারের পতন। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে দেশের আটটি শহরে, যার ফলে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ এবং গ্যাং-সম্পর্কিত সহিংসতা ঘটে। সুপারমার্কেট, ব্যাঙ্ক এবং রাজনীতিবিদদের বাড়িতে হামলা হয়েছে, যদিও বিক্ষোভকারীরা দাবি করছেন এগুলো “পেইড এজেন্ট”দের কাজ।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা (OHCHR) জানিয়েছে, বিক্ষোভে অন্তত ২২ জন নিহত এবং ১০০-এর বেশি আহত। এর মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি, রাবার বুলেট এবং টিয়ার গ্যাস থেকে প্রতিবাদী ও অবাধ্যদর্শীরা আহত হয়েছেন। কিছু মৃত্যু লুটপাট এবং গ্যাং-হামলায় ঘটেছে, যা বিক্ষোভের সাথে সরাসরি যুক্ত নয়। মাদাগাস্কারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সংখ্যা অস্বীকার করে বলেছে, এগুলো “আড্ডা বা ভুল তথ্য” ভিত্তিক। ২৭ সেপ্টেম্বর অ্যান্টানানারিভোতে নিরাপত্তা বাহিনী লাইভ গুলি ব্যবহার করে, যা জাতিসংঘের নিন্দিত।

সরকারের প্রতিক্রিয়া

প্রেসিডেন্ট রাজোয়েলিনা সোমবার টিভি বক্তব্যে সরকার ভেঙে দেন এবং বলেন, “যদি সরকারের সদস্যরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, তাহলে আমরা ক্ষমা চাই এবং তাদের কার্যক্রম বন্ধ করছি।” তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ সব মন্ত্রীদের বরখাস্ত করেছেন এবং তিন দিনের মধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রীর আবেদন গ্রহণ করবেন। গত সপ্তাহে তিনি শক্তি মন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছিলেন। অ্যান্টানানারিভোতে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়েছে, এবং নিরাপত্তা বাহিনী টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে। রাজোয়েলিনা যুবকদের সাথে যোগাযোগ খোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিয়েছেন।

জাতিসংঘের বিবৃতি

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার ভলকার তুর্ক ২৯ সেপ্টেম্বর বিবৃতিতে “অনাবশ্যক এবং অসমানুপাতিক বলপ্রয়োগ” নিয়ে হতবাক প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “নিরাপত্তা বাহিনীকে অবিলম্বে অসমানুপাতিক বল বন্ধ করতে এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তারকৃত প্রতিবাদীদের মুক্তি দিতে হবে।” তুর্ক সহিংসতার স্বাধীন তদন্ত এবং দায়ীদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন। তিনি জোর দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে অস্ত্রের ব্যবহার শুধুমাত্র জীবন রক্ষার জন্যই অনুমোদিত। বিক্ষোভের অধিকার এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা রক্ষা করার আহ্বান জানিয়েছেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া

এক্স (পূর্বের টুইটার)-এ #MadagascarProtests ট্রেন্ড করছে। কেনিয়া টাইমসের পোস্টে বলা হয়েছে, “মাদাগাস্কার সংকটে, যুব-বিক্ষোভে ২২ জন নিহতের পর রাজোয়েলিনা সরকার ভেঙেছেন।” বেলারুশ ইনসাইডের ভিডিও পোস্টে UN-এর ২২ মৃত্যুর তথ্য শেয়ার হয়েছে। একটি পোস্টে বলা হয়েছে, “দৈনিক ১২ ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের কারণে শক্তি মন্ত্রী বরখাস্ত।”

ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

মাদাগাস্কার ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে একাধিক বিদ্রোহের সাক্ষী। ২০০৯ সালের ব্যাপক বিক্ষোভে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মার্ক রাভালোমানানা পদত্যাগ করেন, যার ফলে রাজোয়েলিনা ক্ষমতায় আসেন। ২০২৩-এ তার পুনর্নির্বাচনের পরও অর্থনৈতিক অস্থিরতা চলছে। এই বিক্ষোভ রাজোয়েলিনার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, যা দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও তীব্র করেছে।