রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নাকি সাজানো নাটক? হিরো আলমের হামলা ঘিরে বিতর্ক

২০২৩ থেকে ২০২৫: হিরো আলমের উপর বারবার হামলার রাজনৈতিক রহস্য!

টুইট প্রতিবেদক: রাজধানীর আফতাবনগর এলাকায় সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাত আনুমানিক ৯টার দিকে আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের উপর একদল মোটরসাইকেল চালিত দুর্বৃত্তের নৃশংস হামলার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। হামলায় গুরুতর আহত হয়ে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে যান হিরো আলম।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুসারে, কয়েকটি মোটরসাইকেলে আসা ৪-৫ জন তরুণ তাকে অতর্কিতভাবে ঘিরে ফেলে এলোপাথাড়ি মারধর শুরু করে। হামলাকারীরা কোনো কথা না বলে তাকে মারতে মারতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, তারপর দ্রুত স্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে কাছাকাছি একটি স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান, কিন্তু অবস্থার অবনতির পর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।

হিরো আলমের স্ত্রী রিয়া মনি ঘটনার বিবরণ নিশ্চিত করে জানান, হামলার সময় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তিনি বলেন, “ডাক্তাররা বলেছেন, অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। যেকোনো সময় আরও খারাপ কিছু হতে পারে। আমরা তাকে বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। সবাই দোয়া করুন যেন তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেন।” সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন হিরো আলম। তার মুখমণ্ডল, হাত-পা এবং শরীরের অন্যান্য অংশে আঘাতের স্পষ্ট চিহ্ন রয়েছে।

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, কয়েকজন ব্যক্তি মিলে আহত অবস্থায় তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলছেন, যেখানে তার মাথা ও শরীরে ব্যান্ডেজ বাঁধা। তার পরিধেয় টি-শার্ট ছেঁড়া অবস্থায় রয়েছে, যা হামলার নৃশংসতা প্রকাশ করে।

পুলিশের বক্তব্য

বাড্ডা থানার আফতাবনগর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক (এসআই) সোহেল রানা জানান, “আমরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে ঘটনাটি জেনেছি। ঘটনাস্থল নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। এখনও সঠিক স্পট সম্পর্কে তথ্য পাইনি।” তিনি আরও বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য সংগ্রহ করে তদন্ত শুরু করা হবে। তবে স্থানীয় সূত্র জানায়, হামলাকারীদের ধরতে এখনও কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি। এদিকে, রাজধানী পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঘটনার তদন্তে নির্দেশ দিয়েছেন।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

হিরো আলমের রাজনৈতিক জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হলো ২০২৩ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন। এই নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের (আরাফাত) বিরুদ্ধে লড়াই করেন। হিরো আলমের সমর্থকরা এই লড়াইকে তার সোশ্যাল মিডিয়া-ভিত্তিক জনপ্রিয়তার প্রমাণ হিসেবে দেখেন, যদিও ফলাফল তার পক্ষে যায়নি। তবে এই নির্বাচনের সময় তার উপর হামলার ঘটনা ঘটে, যা তার রাজনৈতিক ঝুঁকি এবং বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে তুলে ধরে।

আরাফাত, তৎকালীন তথ্য ও প্রচারণা প্রতিমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনের আগে হিরো আলম অভিযোগ করেন যে, তার এজেন্টদের ভোট কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে এবং ভোট চুরির সম্ভাবনা রয়েছে। ভোটার উপস্থিতি ছিল মাত্র ১১.৫১%, যা নির্বাচনের বিতর্ককে আরও বাড়িয়ে তোলে।

হিরো আলম, আসল নাম আশরাফুল আলম, বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন আলোচিত মুখ। তিনি ফেসবুক, ইউটিউব এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বিনোদনমূলক কনটেন্ট তৈরি করে লক্ষ লক্ষ ফলোয়ার অর্জন করেছেন। তার ভিডিওগুলো প্রায়শই সরকারের সমালোচনামূলক, বিশেষ করে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নীতি-নীতির বিরুদ্ধে।

২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সময় তার কনটেন্টগুলো বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়, যেখানে তিনি সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন এবং “আগুন জ্বালাও একসাথে আওয়ামী লীগের গদিতে” জাতীয় স্লোগান দিয়েছেন। এই কারণে তাকে অনেকে সত্যিকারের হিরো বলে অভিহিত করেন, কারণ তার ভিডিওগুলো সরকারের জন্য অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

পূর্বের ঘটনাতেও হিরো আলম হামলার শিকার হয়েছিলেন। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বগুড়া উপনির্বাচনের সময় তার উপর হামলা হয়, যার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “হিরো আলমকে মারধরে দলের কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বিদেশি দূতাবাসগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে বিবৃতি দিয়েছিল। কিন্তু এবারের হামলা সংঘটিত হয়েছে আওয়ামী লীগের পতনের পরবর্তী সময়ে, যা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন।

সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিক্রিয়া

হিরো আলমের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে রাত সোয়া ১০টার দিকে পোস্ট করা হয়: “আফতাবনগরে হিরো আলমের উপর সন্ত্রাসীদের হামলা। অজ্ঞান অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।” এই পোস্টে হাজার হাজার লাইক, শেয়ার এবং কমেন্ট এসেছে। এক্স (পূর্বের টুইটার)-এও ট্রেন্ড হয়েছে #HeroAlomAttack। কিন্তু প্রতিক্রিয়া বিভক্ত: কেউ কেউ এটাকে “সাজানো নাটক” বলে অভিযোগ করছেন, যেমন জয় বাংলা অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট: “হিরো আলমের উপর সাজানো ‘হামলা নাটক’ এর ব্যাপারে এক কালে মার্কিন ও ইউরোপীয় দূতাবাস থেকে বিবৃতি আসতো।” অন্যদিকে, সমর্থকরা এটাকে রাজনৈতিক সন্ত্রাস বলে প্রতিবাদ করছেন এবং দ্রুত তদন্তের দাবি জানাচ্ছেন। সময় টিভির মতো চ্যানেলও লাইভ আপডেট দিয়েছে: “হামলাকারীরা কয়েকটি মোটরসাইকেলে এসে হিরো আলমকে…”

কেন হিরো আলম টার্গেট?

হিরো আলমের কনটেন্টগুলো শুধু বিনোদন নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি নিয়মিত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি, দমনমূলক নীতি এবং ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনা নিয়ে কথা বলতেন। তার একটি ভিডিওতে বলা হয়েছে, “আগুন জ্বালাও একসাথে শেখ হাসিনার গদিতে,” যা লক্ষ লক্ষ ভিউ পেয়েছে। এমনকি ২০১৯ সালে তিনি শেখ হাসিনাকে চিঠি লিখে রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি জানিয়েছিলেন। এই কারণে তাকে সরকারের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল, এবং এবারের হামলাও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এখনও কোনো বিবৃতি দেয়নি, যা পূর্বের ঘটনার সাথে তুলনায় অস্বাভাবিক।

হিরো আলমের সুস্থতার জন্য দোয়া করা ছাড়াও, এই হামলা বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্টদের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। পুলিশের তদন্তের ফলাফলের অপেক্ষায় রয়েছে সবাই। যদি এটি রাজনৈতিক হয়, তাহলে এর পেছনে কারা—এটাই হবে পরবর্তী বড় প্রশ্ন।