খাগড়াছড়ি-গুইমারায় ইউপিডিএফ-উস্কানিতে সহিংসতা: শান্তি বজায় রাখতে সেনা প্রস্তুত

খাগড়াছড়ি-গুইমারায় ইউপিডিএফ-এর সহিংসতা: ৩ নিহত, ১৩ সেনা আহত; পার্বত্য অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার
টুইট প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি এবং গুইমারা উপজেলায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং তার অঙ্গসংগঠনগুলোর প্ররোচনায় সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা চরমে পৌঁছেছে। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চালক মামুনের হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্তিতে শুরু হওয়া উত্তেজনা ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে তীব্র হয়ে ওঠে।
এক স্কুলছাত্রীর ধর্ষণ অভিযোগকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ মিছিল, হরতাল, রাস্তা অবরোধ এবং সশস্ত্র সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সহিংসতায় অন্তত ৩ জন পাহাড়ি নিহত, ১৩ সেনা সদস্যসহ কয়েক ডজন মানুষ আহত হয়। সেনাবাহিনী এই ঘটনাগুলোকে ‘সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করে এবং শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। জেলা প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেছে এবং অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
গত বছরের হত্যাকাণ্ড ও উত্তেজনার সূত্রপাত
গত বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর, খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চালক মামুনের হত্যাকাণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এর পর ইউপিডিএফ ও তার সহযোগী অঙ্গসংগঠনসমূহ, যেমন পিস কমিটি (পিসিপি), পাহাড়ি ও বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ২০২৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, মামুন হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্তিতে ইউপিডিএফ প্রতিবাদ মিছিল আয়োজন করে, যা সহিংসতায় রূপ নেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়, যা বাঙালি জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে উত্তেজনা বাড়ায়।
ধর্ষণ অভিযোগ থেকে সশস্ত্র সংঘর্ষ
২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় এক স্কুলছাত্রীর ধর্ষণ অভিযোগের পর শয়ন শীল নামে ইউপিডিএফ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরও ইউপিডিএফ ও অঙ্গসংগঠন ‘জুম্ম ছাত্র জনতা’ ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল এবং মানববন্ধন ডাকে। ২৪ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে আধাবেলা হরতাল পালিত হয়, অনলাইনে উস্কানিমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে উত্তেজনা বাড়ানো হয়।
২৬ সেপ্টেম্বর ইউপিডিএফ-এর প্ররোচনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। অবরোধ চলাকালীন কর্মীরা সেনাবাহিনীর উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে, এতে ৩ সেনা সদস্য আহত হন। ২৭ সেপ্টেম্বর বাঙালিদের লক্ষ্য করে দাঙ্গা ও নাশকতা চালানো, রাস্তা অবরোধ ও গুলি ছোড়া হয়। খাগড়াছড়ি পৌরসভায় সংঘর্ষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ নেয়। ওই দিনে ৩ জন মারমা সম্প্রদায়ের লোক নিহত হয়, ১৩ সেনা সদস্য আহত হন।
২৯ সেপ্টেম্বর সকালে ইউপিডিএফ-সমর্থিত সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গুইমারা উপজেলার রামসু বাজারে রাস্তা অবরোধ করে। সেনাবাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে দুষ্কৃতিকারীরা দেশীয় অস্ত্র, ইটপাটকেল ও লাঠি দিয়ে হামলা চালায়। এতে ১০ সেনা আহত হন। বিজিবির গাড়ি ভাঙচুর করা হয়, এবং সশস্ত্র সদস্যরা অটোমেটিক অস্ত্র দিয়ে সেনা ও সাধারণ মানুষের উপর ১০০-১৫০ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। বিকেল সাড়ে ৪টায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
অস্ত্র জব্দ ও ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত
সেনাবাহিনী জানায়, ইউপিডিএফ নারীদের ও স্কুলছাত্রীদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে বাধ্য করছে এবং বহিরাগত সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারীদের পার্বত্য অঞ্চলে আনার চেষ্টা চলছে। ২৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে বিজিবি কাপ্তাই ব্যাটালিয়ন দেশীয় অস্ত্রসহ একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে অস্ত্র জব্দ করে। বাসটি বান্দরবান থেকে খাগড়াছড়ি যাচ্ছিল এবং ড্রাইভারের জবানবন্দি অনুযায়ী এগুলো চলমান ঘটনায় ব্যবহার করার জন্য আনা হয়েছিল।
আইএসপিআর বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ১৯ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খাগড়াছড়ি ও গুইমারা এলাকায় সংঘটিত সহিংসতা একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ইউপিডিএফ উত্তেজনা ছড়িয়ে পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলের সকল জাতিগোষ্ঠী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও জনগণকে শান্তি বজায় রাখতে আহ্বান জানিয়েছে।
প্রতিক্রিয়া ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দুঃখ প্রকাশ করে বলেছে, দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে শিগগির ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা সংঘর্ষে নেপথ্য দুর্বৃত্তদের খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়েছেন। ১৪৪ ধারা এখনও কার্যকর আছে, দোকানপাট বন্ধ এবং অবরোধের কারণে এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, ধর্ষণ অভিযোগের তদন্ত চলছে, কিন্তু এটি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সংঘর্ষ ও প্রভাব
পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সহিংসতার ধারাবাহিকতা ও তার প্রভাব একটি স্পষ্ট সময়রেখায় দেখা যাচ্ছে। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চালক মামুন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, যা পার্বত্য অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সূচনা করে। এক বছর পর, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ মামুন হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্তিতে ইউপিডিএফ প্রতিবাদ মিছিল আয়োজন করে, যা সহিংসতার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।
এরপর ২৩ সেপ্টেম্বর, ধর্ষণ অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইউপিডিএফ সদস্য শয়ন শীলকে গ্রেপ্তার করা হয়, যা নতুন বিক্ষোভ ও উত্তেজনার শুরু হিসেবে ধরা হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর, সেনাদের উপর হামলা চালানো হয়, যার ফলে তিনজন সেনা আহত হন। পরবর্তী দিন, ২৭ সেপ্টেম্বর, দাঙ্গা-হাঙ্গামার মধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়, এবং সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও ১৩ সেনা আহত হন।
পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয় ২৮ সেপ্টেম্বর, যখন রামসু এলাকায় সংঘর্ষের সময় ১০ সেনা আহত হন এবং বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র জব্দ করা হয়। এই সময়রেখা স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে, কিভাবে ধারাবাহিক ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কার্যক্রম জোরদার করতে বাধ্য করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের এই অশান্তি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সেনাবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয়, তবে ইউপিডিএফ-এর ভূমিকা নিয়ে তদন্ত জরুরি। সকল পক্ষকে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজতে হবে, যাতে পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতি অটুট থাকে।
পরিস্থিতির জন্য আইএসপিআর ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের নিয়মিত আপডেট অনুসরণ করা প্রয়োজন।







