খাগড়াছড়ি-গুইমারায় সহিংসতা: ৩ নিহত, সেনার দাবি ষড়যন্ত্র

খাগড়াছড়ি-গুইমারায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতা: অন্তত ৩ জন নিহত, সেনার দাবি বৃহত্তর ষড়যন্ত্র

টুইট ডেস্ক: পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় টানা দু’দিনের সহিংসতায় অন্তত তিনজন নিহত এবং কয়েক ডজন আহত হয়েছেন। সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছে ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ির সিঙ্গিনালা এলাকায় মারমা সম্প্রদায়ের এক স্কুলছাত্রীর ধর্ষণ অভিযোগকে কেন্দ্র করে।

ইউপিডিএফ-সমর্থিত সংগঠনগুলো অভিযোগ তুলেছে, সেনা ও পুলিশের গুলিতে ৪-৫ জন আদিবাসী প্রাণ হারিয়েছে। তবে সরকারি পক্ষ থেকে নিহতের সংখ্যা নিশ্চিত করা হয়নি।

সহিংসতার সূত্রপাত ও প্রেক্ষাপট

২৪ সেপ্টেম্বর এক অভিযুক্তকে সেনা সহায়তায় গ্রেপ্তারের পর বাকি অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার না করায় বিক্ষোভ শুরু হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর অর্ধদিবস হরতাল এবং ২৬ সেপ্টেম্বর অবরোধের ডাক দেওয়া হয়।

সেনাবাহিনী অভিযোগ করেছে, ইউপিডিএফ ধর্ষণের ঘটনাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে অস্থিরতা ছড়িয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের এক মোটরসাইকেল চালক হত্যার বার্ষিকীতে প্রতিবাদ মিছিলও উত্তেজনা বাড়িয়েছে।

সহিংসতার চিত্র

২৭ সেপ্টেম্বর: ইউপিডিএফ-সমর্থিত গ্রুপ দাঙ্গা, গুলি, ভাঙচুর, অ্যাম্বুলেন্স আক্রমণ ও রাস্তা অবরোধ করে। পরিস্থিতি সাম্প্রদায়িক রূপ নিলে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে। সেনা, বিজিবি ও পুলিশ রাতভর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।

২৮ সেপ্টেম্বর: গুইমারার রামসু বাজারে সংঘর্ষে সেনাদের উপর দেশীয় অস্ত্র ও গুলতি দিয়ে হামলা হয়, যাতে ৩ অফিসারসহ ১০ সেনা আহত হন। বিজিবির গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। বিকেল নাগাদ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।

ভিন্নমত ও অভিযোগ

আদিবাসী নেতারা অভিযোগ করেছেন, সেনা ও বাঙালি সেটলাররা মিলে আদিবাসীদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট পুড়িয়ে দিয়েছে। তাদের দাবি, অন্তত ১৫টি ঘর ও ৬০টি দোকান আগুনে পুড়েছে এবং ৪০ জন আহত হয়েছেন। ইউপিডিএফ (প্রসীত) নেতা রবি চন্দ্র চাকমা জানিয়েছেন, সংঘর্ষে তাদের একজন কর্মী নিহত হয়েছেন। তবে, স্থানীয় কিছু সূত্র দাবি করেছে যে, ইউপিডিএফ-এর অভিযোগ মিথ‌্যা, তারা নিজেরাই কিছু ক্ষতিকর কাজগু‌লো করে সরকারের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও সূত্রের মতে, ইউপিডিএফ-এর অভিযোগ আংশিক সত্য হলেও, তারা নিজেরা অগ্নিসংযোগ ও সহিংসতায় জড়িত ছিল। তারা দাবি করছে, ইউপিডিএফ সরকার ও সেনাবাহিনীর ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের কর্মকাণ্ড ঢাকার চেষ্টা করছে। এই দাবির সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি, তবে সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে ইউপিডিএফ-কে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়েছে।

সেনাবাহিনী ও সরকারের অবস্থান

আইএসপিআর দাবি করেছে, ইউপিডিএফ মহিলা-শিশুদের নাশকতায় ব্যবহার করছে এবং বহিরাগত সন্ত্রাসী আনছে—এটি একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ। সেনারা সকল জাতিগোষ্ঠীকে সংযমের আহ্বান জানিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

ক্ষয়ক্ষতি ও মানবিক প্রভাব

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের প্রাথমিক হিসাব: খাগড়াছড়ি ডেপুটি কমিশনার এমডি শহীদুজ্জামানের বিবৃতি অনুসারে, সহিংসতায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭ কোটি টাকা। এতে ৮৭টি স্থায়ী দোকান এবং ৯৪টি মোবাইল রোডসাইড দোকান পুড়ে যায়। রামসু বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় অগ্নিসংযোগের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আহতদের হাসপাতালে পৌঁছানোর অসুবিধা এবং ৫ জন নিখোঁজের খবরও ছ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে‌ছে, ত‌বে সত‌্যতা জানা যায়‌নি।

সহিংসতার ফলে পর্যটন খাতও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে; প্রতিদিন প্রায় ৮০ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে, যা দুই সপ্তাহে ১০ কোটিরও বেশি।

আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের আহ্বানের সূত্র

ইউপিডিএফ (প্রসীত) এবং আদিবাসী অধিকার গ্রুপগুলো (যেমন জুম্ম ছাত্র জনতা) এই ঘটনাকে আদিবাসীদের উপর সিস্টেম্যাটিক হামলা বলে দাবি করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং জাতিসংঘের কাছে তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে।

এই আহ্বান সোশ্যাল মিডিয়া এবং কিছু সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে, এই দাবির সরাসরি প্রতিক্রিয়া এখনও প্রকাশিত হয়নি; এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক জমি-সংশ্লিষ্ট উত্তেজনার সাথে যুক্ত।

উল্লেখ‌্য যে, মণিপুরের সাম্প্রতিক জাতিগত সহিংসতায় মোদির সাম্প্রতিক সফর (সেপ্টেম্বর ২০২৫) এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ঘোষণা (৭,৩০০ কোটি রুপির মূল্যের) এই আহ্বানকে প্রভাবিত করতে পারে, কিন্তু খাগড়াছড়ির ঘটনায় সরাসরি যুক্ততা নেই।

১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে জমি ও জাতিগত উত্তেজনা বিদ্যমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সহিংসতা আবারও প্রমাণ করেছে যে শান্তিপূর্ণ সমাধান ও আইনি পথ অনুসরণ ছাড়া স্থায়ী শান্তি আসবে না। ত‌বে বর্তমান ঘটনা দে‌শের বিরু‌দ্ধে একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশ।