বান্দরবানে ৩২ মণ্ডপে উৎসবের আমেজ, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা

শারদীয় দুর্গোৎসব ২০২৫: বান্দরবানে ৩২ মণ্ডপে উৎসবের আমেজ, নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় প্রশাসন তৎপর

বান্দরবান প্রতিনিধি: তুলির আঁচড়ে দেবী দুর্গার জীবন্ত রূপ ফুটে উঠেছে মাটির প্রতিমায়। দেবীর বোধনে শুরু হয়েছে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা। পার্বত্য জেলা বান্দরবানের ঐতিহাসিক রাজার মাঠে আজ রোববার মহাষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে সূচনা হয়েছে শারদীয় দুর্গোৎসবের।

এই পাঁচ দিনের উৎসব চলবে আগামী ২ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জন পর্যন্ত। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে আনন্দের বার্তা, আর ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে আয়োজকরা।

জেলায় এবার ৩২টি মণ্ডপে অনুষ্ঠিত হবে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। এর মধ্যে ২২টি মণ্ডপকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। গত বছরের তুলনায় মণ্ডপের সংখ্যা বেড়েছে, যা উৎসবের ব্যাপ্তি বাড়িয়েছে। উপজেলাভিত্তিক মণ্ডপের বিভাজন হলো: সদরে ১১টি, লামায় ৮টি, আলিকদমে ৫টি, নাইক্ষ্যংছড়িতে ৪টি, থানচিতে ২টি, রুমায় ১টি এবং রোয়াংছড়িতে ১টি।

উৎসবের সময়সূচি

বান্দরবান জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সূত্রে জানা গেছে, এবারের দুর্গোৎসব শুরু হয়েছে ২১ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্য দিয়ে। মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে ২৭ সেপ্টেম্বর মহাপঞ্চমী ও দেবীর বোধনের মাধ্যমে।

– ২৮ সেপ্টেম্বর: মহাষষ্ঠী
– ২৯ সেপ্টেম্বর: সপ্তমী
– ৩০ সেপ্টেম্বর: অষ্টমী
– ১ অক্টোবর: নবমী
– ২ অক্টোবর: বিজয়া দশমী ও প্রতিমা বিসর্জন

ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, এ বছর দেবী দুর্গা গজে (হাতি) চড়ে আগমন করবেন এবং দোলা বা পালকিতে বিদায় নেবেন। এটি শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

প্রতিমা তৈরি ও আয়োজনের ব্যস্ততা

জেলার সব মণ্ডপে চলছে প্রতিমা ও সাজসজ্জার শেষ মুহূর্তের কাজ। ঐতিহাসিক রাজার মাঠসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিমাশিল্পীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, মাটির প্রতিমায় শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় ফুটে উঠছে অপরূপ রূপ। কারিগররা জানিয়েছেন, প্রতিবছরের মতো এবারও তারা অধীর আগ্রহে কাজ করেছেন। ছোট-বড় প্রতিমা তৈরি করে একেকজন লক্ষাধিক টাকা আয় করেন, যা তাদের বার্ষিক জীবিকার বড় অংশ। সারা বছর কাজ না থাকলেও পূজার সময় একাধিক অর্ডার পান তারা। আয়োজকরা আশা করছেন, যথাসময়ে সব মণ্ডপ সজ্জিত হবে এবং উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই অংশ নেবে।

কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক প্রস্তুতি

উৎসবকে নির্বিঘ্ন করতে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আজ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বৈঠকে হিন্দু সম্প্রদায়, রাজনৈতিক দলের নেতা এবং ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। পুলিশ সুপার শহিদুল্লাহ কাওছার বলেন, “পূজা শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আমরা তৎপর। গোয়েন্দা সংস্থা সজাগ, কুইক রেসপন্স টিম রেডি এবং মোবাইল পেট্রোলিং থাকবে। দুর্গম এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ মণ্ডপে স্থায়ী নিরাপত্তা নেওয়া হচ্ছে।”

নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রয়েছে-
– প্রতিটি মণ্ডপে সিসি ক্যামেরা স্থাপন।
– স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন।
– আজানের সময় মাইক বন্ধ রাখা।
– তিনস্তরের নিরাপত্তা বলয়: পুলিশ টহল, সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি এবং আনসার-গ্রাম পুলিশ।
– সেনাবাহিনী মাঠে রয়েছে।
– জরুরি সেবা: ৯৯৯ এবং প্রশাসনের মোবাইল নম্বর।

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল করিম (প্রশাসন ও অর্থ), জিনিয়া চাকমা (ক্রাইম অ্যান্ড অপস), জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মুজিবুর রশীদ জসিম উদ্দীন, জামায়াত ইসলামীর নায়েবে আমির অ্যাড. মোহাম্মদ আবুল কালাম, নাগরিক পার্টির আবুল কালাম, কেন্দ্রীয় মসজিদের খতিব আলাউদ্দীন ইমামী, বাজার মসজিদের খতিব এহসানুল হক আল মইন, প্রেস ক্লাবের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বাচ্চুসহ অনেকে।

মন্দির কমিটির আহ্বায়ক নিখিল কান্তি দাশ বলেন, “পূজা শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপনে সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আসন্ন নির্বাচনের আমেজ থাকলেও সব রাজনৈতিক দলের সহায়তা আশা করি।”

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি রাজেশ্বর দাশ বিপ্লব বলেন, “শান্তিপূর্ণ উৎসবের লক্ষ্যে সেনাবাহিনী, সিসিটিভি এবং স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করবে। গত বছরের মতো এবারও শঙ্কাহীন উৎসব হবে।” তিনি আরও জানান, ২৯ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক রাজার মাঠে ১৫ জন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে অসহায় মানুষের জন্য দিনব্যাপী বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হবে।

জেলা প্রশাসক মিস শামীম আরা রিনি জানান, “প্রশাসন, পুলিশ এবং পূজা পরিষদের নেতাদের সঙ্গে প্রস্তুতিমূলক সভা শেষ হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় আর্ট গ্যালারি স্থাপন করা হয়েছে।”

অনুদান এবং সহায়তা

পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সবুজ দত্ত বাচ্চু বলেন, “প্রতিটি মণ্ডপে সরকারের পক্ষ থেকে সেনা রিজিয়ন, জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসক, পুলিশ প্রশাসন, পৌরসভা, হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্ট এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।”

পূজা উদযাপন পরিষদ আশাবাদী যে, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে শেষ হবে এবারের দুর্গোৎসব। এটি শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে।