প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে সুদান গুরুং: জেন-জি প্রজন্মের ঝড়ে কাঁপছে নেপালের পুরনো দলগুলো
- নেপাল: জেন-জি বিপ্লব থেকে প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে সুদান গুরুং
- নেপালের জেন-জি বিপ্লবের নেতা সুদান গুরুং: আন্দোলন থেকে নির্বাচনী ময়দানে, প্রধানমন্ত্রীর পদের দাবিতে প্রস্তুত।
টুইট প্রতিবেদক: নেপালের তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বাধীন গণবিক্ষোভ যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে জ্বলে উঠে একটি সরকারের পতন ঘটিয়েছে, সেই আন্দোলনের মুখপাত্র সুদান গুরুং এখন রাজনৈতিক ময়দানে নামছেন। ৩৬ বছর বয়সী এই তরুণী, যিনি জেন-জি প্রজন্মের প্রতীক হয়ে উঠেছেন, আসন্ন মার্চ মাসের নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন।
আল জাজিরার ‘স্টার্ট হিয়ার’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিক সান্দ্রা গাথম্যানের সাক্ষাৎকারে সুদান বলেন, “আমরা নির্বাচন জিতব।” এই ঘোষণা নেপালের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে এক নতুন ঝড় তুলেছে, যেখানে তরুণ প্রজন্ম পুরনো নেতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দিচ্ছেন।
সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা থেকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ
সুদান গুরুংয়ের নাম নেপালের রাজনীতিতে নতুন নয়, কিন্তু এই মাসের শুরুতে তার নেতৃত্বাধীন আন্দোলন দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ নেপাল সরকার ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম—যার মধ্যে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং এক্স (পূর্বের টুইটার)—নিষিদ্ধ করে। সরকারের দাবি ছিল, এই প্ল্যাটফর্মগুলো নিবন্ধনের নিয়ম না মেনে চলায় দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিল।
জেন-জি প্রজন্ম—যারা ডিজিটাল জগতের স্বাভাবিক অংশ হিসেবে বেড়ে উঠেছে—এই নিষেধাজ্ঞাকে শুধু সেন্সরশিপ নয়, বরং অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব, দুর্নীতি এবং পুরনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি প্রতীক হিসেবে দেখল। কাঠমান্ডু থেকে শুরু হওয়া বিক্ষোভ দ্রুত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৯ জন নিহত হন, ১০০-এর বেশি আহত হন। এই সহিংসতা পরিস্থিতি এতটাই তীব্র হয় যে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়া হয় এবং সংসদ ভবন আগুনে পুড়ে যায়।
সুদান গুরুং এই আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি ‘হামি নেপাল’ নামক একটি অ-সরকারি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা এবং সমন্বয়কারী। সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ হওয়ার পর বিক্ষোভকারীরা ডিসকর্ড, ইনস্টাগ্রামের গোপন চ্যানেল এবং অন্যান্য অফলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সংগঠিত হয়। এই কৌশল সরকারের নিয়ন্ত্রণকে চতুরভাবে এড়িয়ে যায় এবং আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে। বিবিসি-র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ঘটনা এশিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ার দ্বিমুখী ভূমিকা দেখিয়েছে—যা একদিকে বিপ্লবের হাতিয়ার, অন্যদিকে সরকারের নজরদারির লক্ষ্য।
নির্বাচনী ঘোষণা: ‘পুরনো নেতাদের জায়গা নেই’
আল জাজিরার সাক্ষাৎকারে সুদান গুরুং স্পষ্ট করে বলেন, তাঁর দল মার্চ ২০২৬-এর নির্বাচনে (যা সম্ভবত স্থানীয় এবং জাতীয় উপ-নির্বাচনের সমন্বয়) অংশ নেবেন। এটি কোনো একক প্রচেষ্টা নয়, বরং একটি নতুন রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে। তাঁর দল দেশজুড়ে সমর্থকদের সংগঠিত করছে, যার মধ্যে স্বেচ্ছাসেবকরা আইন, যোগাযোগ এবং জনমত সংগ্রহের কমিটি গঠন করেছে। “আমরা প্রচলিত রাজনৈতিক দলের থেকে ভিন্ন কিছু চাই। প্রত্যেক নেপালীর কণ্ঠস্বর নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য,” সুদান বলেন।
তিনি পুরনো রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। “মার্চের নির্বাচনে পুরনো নেতারা অংশ নেবেন না—এটাই আমাদের দাবি। এখন সময় নতুন প্রজন্মের,” তিনি জানান। প্রধানমন্ত্রীর পদ নিয়ে প্রশ্নে সুদানের উত্তর ছিল সতর্কতাপূর্ণ কিন্তু আশাবাদী: “আমি এখনই বলব না যে আমি সঠিক ব্যক্তি। কিন্তু জনগণ যদি আমাকে বেছে নেয়, আমি অবশ্যই প্রার্থী হব।” এই কথা ইউটিউবে ভাইরাল হয়ে উঠেছে, যেখানে তাঁর সাক্ষাৎকারের ক্লিপ লক্ষাধিক বার দেখা হয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়া এবং এক্স (টুইটার)-এর পোস্টগুলো থেকে বোঝা যায়, সুদানের ঘোষণা তরুণদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এক পোস্টে বলা হয়েছে, “জেন-জি বিপ্লব থেকে ব্যালট বক্সে—সুদান গুরুং নেপালের ভবিষ্যত।” আরেকটিতে আল জাজিরার ভিডিও শেয়ার করে লেখা, “ডিসকর্ড আন্দোলন চালিয়েছে, এবার প্রধানমন্ত্রীর দৌড়।”
নতুন দলের পরিকল্পনা
সুদানের দলের কেন্দ্রীয় কৌশল হলো আন্দোলনকালীন ডিজিটাল টুলসের পুনর্ব্যবহার। ডিসকর্ড এবং ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে সমর্থকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে, যাতে স্থানীয় স্তরে জনগণের দাবি সংগ্রহ করা যায়। সিবিসি নিউজের প্রতিবেদন অনুসারে, এই আন্দোলন শুধু সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে নয়, বরং দুর্নীতি, বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক অসমতার বিরুদ্ধে একটি প্রজন্মীয় ক্ষোভের প্রকাশ। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা উল্টো ফিরে এসেছে, কারণ এটি রাজনীতিকে চ্যাটরুমে নিয়ে এসেছে।
সুদানের দল ‘পিপলস গভর্নমেন্ট’ গঠনের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে, যা যুবক-যুবতীদের নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। রয়েটার্সের মতে, এই আন্দোলন নেপালের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায় শুরু করেছে, যেখানে তরুণরা পুরনো দলগুলোকে (যেমন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি এবং নেপালি কংগ্রেস) চ্যালেঞ্জ করছে। গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অধিকাংশই ১৮-২৫ বছর বয়সী, যারা অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবে হতাশ।
বিপ্লবের পর নতুন সুযোগ?
নেপালের সংবিধান অনুসারে, পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন ২০২৭ সালে, কিন্তু মার্চের নির্বাচনগুলো স্থানীয় সভা এবং উপ-নির্বাচনের অংশ। সুদানের এই পদক্ষেপ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। রোসা-লাক্সেমবুর্গ-স্তিফটুং-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, জেন-জি বিক্ষোভ নেপালের রাজনীতিতে একটি ‘নার্ভ স্ট্রাক’ হিসেবে কাজ করেছে, যা পুরনো ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
যদিও সুদানের দল এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত নয়, তাঁর সমর্থকরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। উইকিপিডিয়া অনুসারে, সুদানের পটভূমি এনজিও কাজে, যা তাঁকে জনকল্যাণমুখী নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছে।
তরুণ প্রজন্মের উত্থান
সুদান গুরুংয়ের নির্বাচনী যাত্রা নেপালের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে। এটি শুধু একজন নেত্রীর গল্প নয়, বরং একটি প্রজন্মের যাত্রা—যারা রাস্তা থেকে সংসদে যেতে চায়। যদি সফল হন, তাহলে এটি দক্ষিণ এশিয়ায় যুব-নেতৃত্বের একটি নতুন মডেল স্থাপন করবে। কিন্তু চ্যালেঞ্জও কম নয়: পুরনো দলগুলোর প্রতিরোধ এবং অর্থনৈতিক সংকট। সুদানের কথায় শেষ করি: “জনগণের পছন্দই আমাদের শক্তি।”
সুদান গুরুং নেপালের একজন প্রখ্যাত যুব নেতা, যিনি জেন-জি প্রজন্মের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ১৯৮৯ সালের দিকে জন্মগ্রহণকারী সুদানের প্রারম্ভিক জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সীমিত, তবে তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় এসেছে ২০১৫ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের সময়। এই ভূমিকম্পে তিনি নিজের সন্তানকে হারান, যা তাঁকে সামাজিক কর্মকাণ্ডের দিকে ঠেলে দেয়। সুদানের পারিবারিক পটভূমি সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য না থাকলেও, তাঁর জীবনের এই ব্যক্তিগত দুর্যোগ তাঁকে একজন সাধারণ ব্যক্তি থেকে সমাজসেবক হিসেবে রূপান্তরিত করে।
প্রারম্ভিক ক্যারিয়ারে সুদান গুরুং একজন ডিজে এবং নাইটক্লাব মালিক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, বিশেষ করে কাঠমান্ডুর ওএমজি নাইটক্লাবের সাথে যুক্ত। তাঁর জীবন ছিল পার্টি এবং ক্লাবিং-কেন্দ্রিক, যেখানে তিনি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে দক্ষতা অর্জন করেন। কিন্তু ২০১৫ সালের ভূমিকম্প, যা প্রায় ৯,০০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটায়, তাঁর জীবনকে বদলে দেয়। তিনি বলেন, “একটি শিশু আমার কোলে মারা গিয়েছিল। সেই মুহূর্ত আমি কখনো ভুলব না।” এই ঘটনা তাঁকে দুর্যোগ সহায়তা এবং যুবকদের সংগঠিত করার দিকে ঠেলে দেয়।
ভূমিকম্পের পর সুদান গুরুং ‘হামি নেপাল’ নামক একটি যুব-চালিত অ-সরকারি সংস্থা (এনজিও) গঠন করেন। প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে প্রায় ২০০ স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করে দুর্যোগ সহায়তা শুরু করেন, যা পরবর্তীতে ১,৬০০-এর বেশি সদস্যের একটি শক্তিশালী সংস্থায় পরিণত হয়। হামি নেপালের কার্যক্রমে রয়েছে ভূমিকম্প-পরবর্তী পুনর্বাসন, বন্যা এবং ভূমিধসের সহায়তা, আন্তর্জাতিক তহবিল সংগ্রহ এবং বিদেশে আটকে পড়া নেপালিদের উদ্ধার। সুদান সংস্থার প্রেসিডেন্ট হিসেবে সামাজিক সচেতনতা এবং যুবকদের ক্ষমতায়নের উপর জোর দেন, যা তাঁকে একজন জনপ্রিয় যুব নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে নেপাল সরকারের সোশ্যাল মিডিয়া নিষেধাজ্ঞা (ফেসবুক, এক্স, ইউটিউব সহ ২৬টি প্ল্যাটফর্ম) সুদান গুরুংকে জাতীয়ভাবে আলোচিত করে তোলে। হামি নেপালের নেতৃত্বে তিনি যুবকদের সংগঠিত করে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ডাক দেন, যা পরবর্তীতে সহিংসতায় রূপ নেয়। প্রতিবাদকারীরা স্কুল ইউনিফর্ম পরে বই নিয়ে রাস্তায় নামেন, এবং ডিসকর্ড ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে সমন্বয় করেন। এই আন্দোলন প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির পদত্যাগ ঘটায়, যদিও এতে ১৯ থেকে ৩০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হন। সুদানের ভূমিকা ছিল প্রতিবাদের মূল সংগঠক হিসেবে, যা দুর্নীতি, বেকারত্ব এবং সরকারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে জেন-জি প্রজন্মের ক্ষোভের প্রকাশ।
প্রতিবাদের সাফল্যের পর সুদান গুরুং রাজনৈতিক ময়দানে নামার ঘোষণা দেন। আল জাজিরার সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমরা নির্বাচনে লড়ব, কারণ এখন না হলে কখনো নয়।” মার্চ ২০২৬-এর নির্বাচনে তিনি একক নয়, বরং দলগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার পরিকল্পনা করছেন, যাতে পুরনো রাজনৈতিক নেতাদের বাদ দেওয়া যায়। তাঁর লক্ষ্য ‘পিপলস গভর্নমেন্ট’ গঠন, যা নেপালের ট্যুরিজম উন্নয়ন, ভারত-চীনের সাথে সুসম্পর্ক এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের উপর জোর দেয়। প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “জনগণ যদি আমাকে বেছে নেয়, তাহলে আমি প্রার্থী হব।”
সুদান গুরুংয়ের উত্তরাধিকার হলো নেপালের যুব-চালিত রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতীক। একজন ডিজে থেকে সামাজিক নেতা হয়ে উঠে তিনি প্রমাণ করেছেন যে ব্যক্তিগত দুর্যোগ থেকে জাতীয় আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। তাঁর নেতৃত্বে হামি নেপাল এখন একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম, যা ভবিষ্যতে নেপালের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাঁর কাজ যুবকদের মধ্যে আশা জাগিয়েছে এবং সামাজিক মিডিয়াকে পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।