শেখ হাসিনার ফোনালাপে মারণাস্ত্র ও পোড়ানোর নির্দেশ: ট্রাইব্যুনালে অডিও প্রমাণ

আন্দোলন দমনে ‘লিথাল ওয়েপন’ ব্যবহারের নির্দেশ: শেখ হাসিনা-তাপসের ফোনালাপ অডিও ট্রাইব্যুনালে শোনানো—’যা পোড়াতে বলেছি, সেতু ভবন পুড়িয়ে দিয়েছে’; ৬৯টি অডিও ক্লিপ জব্দ।

টুইট ডেস্ক: জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান দমনে ‘লিথাল ওয়েপন’ (মারণাস্ত্র) ব্যবহার এবং নির্দিষ্ট স্থান পোড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা—এমন ভয়াবহ প্রকাশ পেয়েছে একটি ফোনালাপের অডিওর মাধ্যমে।

বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) এই অডিও শোনানো হয়, যাতে হাসিনা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথোপকথন করছেন। অডিওতে হাসিনা বলেন, “আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। ওপেন নির্দেশনা দিয়েছি। এখন লিথাল ওয়েপন ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে সেখানে গুলি করবে।” এছাড়া, বিটিআরসি-বিটিভি এবং সেতু ভবন পোড়ানোর ঘটনায় তার প্রতিক্রিয়া শুনে সকলে স্তম্ভিত। এই অডিওটি আন্দোলনকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রমাণ হিসেবে জমা হয়েছে, যাতে হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আসামি। বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহার জবানবন্দিতে জানানো হয় যে, হাসিনার ৬৯টি অডিও ক্লিপ এবং তিনটি মোবাইল নম্বরের কল রেকর্ড জব্দ করা হয়েছে। প্রসিকিউটররা বলছেন, এই প্রমাণগুলো আন্দোলন দমনে সরকারের নৃশংসতার স্পষ্ট ছবি তুলে ধরেছে।

অডিওর বিবরণ: ‘লিথাল ওয়েপন’ থেকে পোড়ানোর নির্দেশ—হাসিনার কণ্ঠ স্পষ্ট

আইসিটির এই মামলায় ৫৩ নম্বর সাক্ষী হিসেবে বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা তানভীর হাসান জোহা জবানবন্দি দেন। তাঁর জবানবন্দির সময় শেখ হাসিনা-তাপসের ফোনালাপের অডিও শোনানো হয়, যা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে (জুলাই-আগস্ট ২০২৪) রেকর্ড হয়। অডিওতে হাসিনার কণ্ঠ স্পষ্টভাবে শনাক্ত হয়েছে, যেখানে তিনি বলেন:

মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ, “আমার নির্দেশনা দেওয়া আছে। ওপেন নির্দেশনা দিয়েছি। এখন লিথাল ওয়েপন (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করবে। যেখানে পাবে সেখানে গুলি করবে।”

পোড়ানোর নির্দেশ এবং সেতু ভবনের ঘটনা

“বিটিআরসি-বিটিভি পুড়িয়ে দিয়েছে। এখন ইন্টারনেট বন্ধ। মেশিনপত্র সব পুড়ে গেছে। আমি বলছি যা যা পোড়াতে… আমাদের সেতু ভবন পুড়িয়েছে। আমি পোড়াতে বলেছি কী, ওরা পুড়িয়ে দিয়েছে সেতু ভবন।”

তাপস ফোনালাপে হাসিনাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার কথা বলেন এবং রাতের বেলায় বনানী-গুলশানে ব্যাপক আক্রমণের সম্ভাবনা উল্লেখ করেন। হাসিনা জায়গার নাম জিজ্ঞাসা করেন, এবং তাপস বনানী-গুলশানের কথা বলেন। এই অডিওটি আন্দোলন দমনে সরকারের নির্দেশের সরাসরি প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

সাক্ষীর জবানবন্দি এবং প্রসিকিউটরের বক্তব্য

তানভীর হাসান জোহা জবানবন্দিতে জানান, তদন্তে শেখ হাসিনার ৬৯টি অডিও ক্লিপ এবং তিনটি মোবাইল নম্বরের কল রেকর্ড জব্দ করা হয়েছে। এই রেকর্ডগুলো আন্দোলনকালীন সরকারের নির্দেশের প্রমাণ। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এমএইচ তামিম, ফারুক আহাম্মদ এবং আবদুস সাত্তার পালোয়ানসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম বলেন, “ফোনালাপে শেখ হাসিনা নিজেই আগুন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন—’আমি বললাম একটা জিনিস পোড়াতে, যা যা পোড়াতে। ওরা পুড়িয়ে দিলো সেতু ভবন।’ তার মানে আগুন দেওয়ার নির্দেশ উনি দিয়েছেন। কিন্তু উনার কাঙ্ক্ষিত জিনিস না পুড়িয়ে অন্য স্থাপনা পুড়ানো হয়েছে।” তিনি আরও বলেন, এই অডিওগুলো সরকারের নৃশংসতার স্পষ্ট প্রমাণ।

সকালে রাজসাক্ষী হিসেবে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়, এবং তার উপস্থিতিতে সাক্ষীরা জবানবন্দি দেন। মামলাটি আন্দোলনকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের, যাতে হাসিনা, কামাল এবং মামুন আসামি।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ

জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানটি কোটা সংস্কারের দাবি থেকে শুরু হয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়, যাতে শত শত মানুষ নিহত হয়। আন্দোলন দমনে পুলিশ, জুবো লীগ এবং সরকারি বাহিনীর গুলি, হেলিকপ্টার থেকে অভিযান এবং পোড়ানোর ঘটনা ঘটে। সেতু ভবন, বিটিআরসি এবং বিটিভির মতো স্থাপনা পোড়ানোর ঘটনা এই অডিওতে উল্লেখিত।

এই মামলাটি আন্দোলনকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অংশ, যাতে হাসিনা এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে। তদন্তে ৬৯টি অডিও ক্লিপ জব্দ হয়েছে, যা হাসিনার নির্দেশের প্রমাণ। জাগো নিউজের প্রতিবেদন অনুসারে, অডিওতে হাসিনা-তাপস-ইনু-কামালের কথোপকথন শোনানো হয়েছে, যাতে গুলি চালানোর নির্দেশ স্পষ্ট। জুগান্তরের রিপোর্টে বলা হয়েছে, অডিওতে হাসিনার কণ্ঠ স্পষ্ট শনাক্ত হয়েছে। রেডিও টুডে নিউজে উল্লেখ করা হয়েছে, সেতু ভবন-বিটিভি-মেট্রোরেলে আগুন দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাসিনা।

এই অডিও প্রকাশের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে, যদিও সার্চে সাম্প্রতিক পোস্ট সীমিত। ইউটিউব চ্যানেলগুলোতে (যেমন চ্যানেল এস নিউজ, আরটিভি নিউজ) ভিডিও আপলোড হয়েছে, যাতে প্রসিকিউটরের বক্তব্য এবং অডিওর অংশ শোনানো হয়েছে। সমালোচকরা এটিকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ’ বলে অভিহিত করছেন, যখন হাসিনার সমর্থকরা অডিওর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রমাণগুলো হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাকে শক্তিশালী করবে এবং আন্দোলনকালীন হত্যাকাণ্ডের তদন্তকে ত্বরান্বিত করবে। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ন্যায়বিচারের প্রচেষ্টার একটি মাইলফলক, যা ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে।

এই অডিও প্রকাশ আন্দোলনের শিকার পরিবারগুলোর জন্য ন্যায়বিচারের আশা জাগিয়েছে।