জাতিসংঘে বাংলাদেশ: ইউনুসের কূটনৈতিক যাত্রা আন্তর্জাতিক নজরে
মুহাম্মদ ইউনুসের জাতিসংঘ সফর: ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের বহুমুখী কূটনৈতিক কার্যক্রম
জাতিসংঘের মঞ্চে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দাপট: মুহাম্মদ ইউনুসের ব্যস্ত নিউইয়র্ক সফর।
টুইট প্রতিবেদন: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চিফ অ্যাডভাইজার প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৮০তম সাধারণ অধিবেশনের উদ্বোধনী সেশনে অংশগ্রহণ করেছেন।
জাতিসংঘের এই বিশেষ অধিবেশন বিশ্ব শান্তি, উন্নয়ন ও মানবাধিকারের ৮০ বছরের ইতিহাস উদযাপনের জন্য আয়োজন করা হয়, যার থিম ছিল “Better Together: 80 years and more for peace, development and human rights”।
প্রফেসর ইউনুসকে সঙ্গী করেন উপদেষ্টা ফৌজুল কবীর খান (শক্তি বিষয়ক), তৌহিদ হোসেন (বিদেশ) এবং আসিফ নজরুল (আইন), যারা বাংলাদেশের অবস্থান আন্তর্জাতিক মঞ্চে দৃঢ় করতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। এই সফর বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংক্রমণকালীন স্থিতিশীলতা, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরার গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে।
উদ্বোধনী সেশন সকাল ৯টা থেকে ১০টায় অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস সভাপতিত্বে সভায় অংশগ্রহণকারীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার স্মৃতি তুলে ধরেন এবং বর্তমান বিশ্ব সংকট যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, শান্তিরক্ষা, অর্থনৈতিক অসমতা ও মানবাধিকারের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন। প্রফেসর ইউনুস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে উপস্থিত হয়ে দেশের অবস্থান, রোহিঙ্গা সংকট ও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানান।
উদ্বোধনী সেশনের আগে প্রফেসর ইউনুস একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নেন। আলোচনার উল্লেখযোগ্য দিক হলো-
উরুগুয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিও লুবেটকিন: লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার উপায় আলোচনা।
চিলির সাবেক রাষ্ট্রপতি মিশেল বাচেলেট: মানবাধিকার, যুবক কর্মসংস্থান ও সামাজিক ব্যবসা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গার: এলডিসি স্নাতকতা, অর্থনৈতিক সংস্কার ও আর্থিক সহায়তার বিষয়ে সমন্বয়। বিশ্বব্যাংক ৩.৫ বিলিয়ন ডলারের সমর্থন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ডব্লিউটিও মহাপরিচালক নগোজি ওকোনজো-ইওয়েলা এবং নেদারল্যান্ডসের রানী ম্যাক্সিমা: এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সমর্থন ও মসৃণ স্থানান্তরের বিষয় নিয়ে আলোচনা।
সামাজিক উদ্ভাবন ও পাবলিক-প্রাইভেট সেক্টর নেতাদের বৈঠক: সামাজিক উদ্ভাবনের মাধ্যমে অর্থায়ন এবং সমাজকল্যাণ প্রকল্পের প্রসার।
সফরের দিনভরের অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে ছিল মহিলাদের নেতৃত্ব ও টেকসই উন্নয়নের ওপর ফোরাম, সামাজিক উদ্ভাবন নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ, এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডির আয়োজিত অভ্যর্থনায় অংশ নেওয়া।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
নিউইয়র্কে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিনিধি আখতার হোসেনের ওপর কিছু বিরোধী গ্রুপ ডিম ছুড়ে প্রতিবাদ চালায়। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং ইউনুসের অফিস এই ঘটনা ‘দুর্ভাগ্যজনক’ হিসেবে বর্ণনা করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সমর্থকরা এটিকে বাংলাদেশের ঐক্যের প্রতীক মনে করছেন, অন্যদিকে বিরোধীরা রাজনৈতিক প্রতিবাদের আকারে এটিকে উল্লেখ করেছেন।
কূটনৈতিক প্রভাব এবং প্রত্যাশিত ফলাফল
প্রফেসর ইউনুসের এই সফর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সমর্থন বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ। এলডিসি স্নাতকতার প্রক্রিয়ায় সহায়তা, বাণিজ্যিক সুযোগ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সহায়তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এই সফর ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি জাতিসংঘ জেনারেল ডিবেটে বক্তব্য দেবেন, যেখানে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, জলবায়ু ন্যায়বিচার, শান্তিরক্ষা এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের মতো বিষয় তুলে ধরবেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাকে শক্তিশালী করবে।
সফর শেষ হবে ২ অক্টোবর। প্রধান উপদেষ্টার এই সফর বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তাঁর বৈঠকগুলো থেকে প্রত্যাশিত যে, বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্যিক সুবিধা এবং আর্থিক সহায়তা পাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সফর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়ক হবে। সফরের পরবর্তী দিনগুলোতে আরও বৈঠক এবং ইভেন্ট রয়েছে, যা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে আরও মজবুত করবে।