সাত যুদ্ধ বন্ধ করেছি, ফোনও পেলাম না: ক্ষোভ ট্রাম্পের

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মঙ্গলবার বক্তব্য দেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। ছবি- রয়টার্স

৮০তম সাধারণ অধিবেশনে ট্রাম্পের অভিযোগ—”সাতটি।

জাতিসংঘের অধিবেশনে ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা: খারাপ এসক্যালেটর, টেলিপ্রম্পটার এবং যুদ্ধবিরতির অবহেলা—তিন নালিশ যা বিশ্বকে চমকে দিল।

বিশ্ব ডেস্ক: জাতিসংঘের ৮০তম সাধারণ অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য এক অভিনব রূপ নিল। মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত এ অধিবেশনে তিনি কেবল “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতি নিয়ে কথা বলেননি, বরং শুরু থেকেই জাতিসংঘকে উদ্দেশ করে তিনটি নির্দিষ্ট অভিযোগ বা নালিশ তুললেন।

এগুলো হলো—জাতিসংঘ ভবনের খারাপ এসক্যালেটর, খারাপ টেলিপ্রম্পটার এবং তার দাবি করা সাতটি যুদ্ধবিরতির স্বীকৃতি না পাওয়া। বক্তৃতা জুড়ে ট্রাম্পের ভঙ্গি কখনো আক্রমণাত্মক, কখনো বিদ্রূপাত্মক, আবার কখনো কৌতুকপূর্ণ হয়ে ওঠে, যা উপস্থিত বিশ্ব নেতাদের মধ্যে হাস্যরস ও অস্বস্তি দুটোই সৃষ্টি করে।

প্রথম ঘটনাটি ঘটে জাতিসংঘ ভবনে প্রবেশের সময়। ট্রাম্প ও ফার্স্ট লেডি মেলানিয়া ট্রাম্প এসক্যালেটরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই এটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। এতে মেলানিয়া প্রায় পড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়েন, যদিও সিক্রেট সার্ভিস দ্রুত সামলে নেয়। এরপর অধিবেশনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় টেলিপ্রম্পটার হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এই দুই ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রাম্প ক্ষোভ ও হাস্যরস মিশিয়ে বলেন, “জাতিসংঘ আমাকে দুটি জিনিস দিয়েছে—একটি খারাপ এসক্যালেটর এবং একটি খারাপ টেলিপ্রম্পটার।” এই মন্তব্যে কক্ষে উপস্থিত বিশ্ব নেতাদের অনেকেই হেসে ওঠেন। পরে তিনি রসিকতা করে যোগ করেন, “টেলিপ্রম্পটারের পরিচালক এখন বড় সমস্যায় পড়বেন।”

জাতিসংঘ অবশ্য এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছে। মুখপাত্র স্টেফেন ডুজারিক জানান, এসক্যালেটরটি ট্রাম্পের দলেরই এক সদস্য ভুলবশত বন্ধ করেছিলেন। আর টেলিপ্রম্পটারও ছিল ওয়াইট হাউস টিমের নিয়ন্ত্রণে, জাতিসংঘের নয়। অন্যদিকে, ওয়াইট হাউস প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট জাতিসংঘের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “যদি ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিভ্রাট ঘটানো হয়ে থাকে, তবে দায়ীদের বরখাস্ত করে তদন্ত করতে হবে।” এমনকি সিক্রেট সার্ভিসও ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে, যাতে কোনো বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এরপর ট্রাম্প তার সবচেয়ে বড় নালিশ তুললেন যুদ্ধবিরতির স্বীকৃতি না পাওয়া নিয়ে। তিনি দাবি করেন, “আমি সাতটি যুদ্ধ বন্ধ করেছি। এসব দেশের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতা করেছি, চুক্তি করেছি। কিন্তু জাতিসংঘ আমাকে ধন্যবাদ জানাতেও ফোন করেনি।” তার এই বক্তব্যে সমর্থকরা একে তার শান্তি প্রচেষ্টার প্রমাণ হিসেবে প্রচার করছে। সামাজিক মাধ্যমে লেখা হচ্ছে, “ট্রাম্প সাত যুদ্ধ বন্ধ করেছেন, অথচ জাতিসংঘ কোনো স্বীকৃতি দেয়নি—এ কারণেই জাতিসংঘকে ডিফান্ড করতে হবে।”

তবে সমালোচকরা বলছেন, যুদ্ধবিরতির সংখ্যা অতিরঞ্জিত। বাস্তবে তার মেয়াদকালে মধ্যপ্রাচ্য, আফগানিস্তান কিংবা ইউক্রেনের মতো সংঘাতগুলো শেষ হয়নি। নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের প্রতিবেদনে এটিকে “পুরনো অভিযোগ ও মিথ্যা দাবির মিশ্রণ” হিসেবে উল্লেখ করেছে।

৪০ মিনিটের বক্তৃতায় ট্রাম্প আরও নানা বিষয় নিয়ে জাতিসংঘকে সমালোচনা করেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে “হোক্স” বলে উড়িয়ে দেন এবং সতর্ক করেন, “দেশগুলো শক্ত সীমান্ত ও শক্তি আধিপত্য গ্রহণ না করলে নরকের দিকে যাবে।” একইসাথে অভিবাসন সংকট ও জ্বালানি সমস্যায় জাতিসংঘের ব্যর্থতাও তুলে ধরেন। তার ভাষায়, “জাতিসংঘ আমেরিকার অর্থের উপর নির্ভরশীল অথচ কার্যকর কোনো সমাধান দিচ্ছে না।”

এই বক্তৃতার প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। ট্রাম্পের সমর্থকরা এক্স-এ (পূর্বের টুইটার) তার বক্তব্যকে “পাওয়ারহাউস” আখ্যা দিয়ে প্রশংসা করেছেন। ফক্স নিউজ উপস্থাপক লুরা ইঙ্গ্রাহাম লিখেছেন, “টেলিপ্রম্পটার ফেল করলেও ট্রাম্প এক বিটও মিস করেননি।” অপরদিকে বিরোধীরা এটিকে “লজ্জাজনক” অভিহিত করেছেন।

সমালোচকদের মতে, বিভ্রাটের জন্য ট্রাম্পের নিজের টিমই দায়ী। যদিও জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প পরে তুলনামূলক নরম সুরে বলেন, “আমরা জাতিসংঘের পক্ষে ১০০%।”

প্রেক্ষাপট অনুযায়ী, এটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় জাতিসংঘ অধিবেশন বক্তব্য। এর আগে ২০১৮ সালে তিনি জাতিসংঘকে অকার্যকর বলে আক্রমণ করেছিলেন। বর্তমানে আমেরিকা জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় অর্থায়নকারী—২০২৩ সালে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এই নতুন অভিযোগ ভবিষ্যতে মার্কিন অর্থায়ন কমানোর বিতর্ককে উসকে দিতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, ট্রাম্পের এই তিন নালিশ—এসক্যালেটর, টেলিপ্রম্পটার ও যুদ্ধবিরতির স্বীকৃতি না পাওয়া—জাতিসংঘ অধিবেশনকে শুধু হাস্যরসাত্মক করে তোলেনি, বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও নতুন ধরনের উত্তেজনার ইঙ্গিত দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও কীভাবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে বড় সমালোচনার হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।