বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত সংকটের মুখে: সতর্কবাণী

অত্যধিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির ফলে ব্যাংকিং খাত সংকটের মুখে: নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের সতর্কবাণী।

টুইট ডেস্ক: বাংলাদেশের ছোট অর্থনীতিতে অত্যধিক সংখ্যক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির উপস্থিতি ব্যাংকিং খাতকে সংকটের মুখে ফেলেছে। নিউ অরলিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম কবির হাসান এই সতর্কবাণী দিয়েছেন। তিনি জানান, এজেন্সিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতার কারণে রেটিং নির্ধারণে গুণমান ও সঠিকতার অভাব দেখা দিয়েছে, যা ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি মূল্যায়নকে প্রভাবিত করছে।

সোমবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে আয়োজিত এক সেমিনারে ‘কি নোট’ প্রেজেন্টেশনে অধ্যাপক হাসান এই তথ্য তুলে ধরেন। সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং খাতের বর্তমান অবস্থা

অধ্যাপক হাসানের মতে, বাংলাদেশের মতো ছোট অর্থনীতিতে ৮টি ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির উপস্থিতি অস্বাভাবিক। এই এজেন্সিগুলো হলো আলফা ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড, আর্গাস ক্রেডিট রেটিং সার্ভিসেস লিমিটেড, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিআরএবি), ক্রেডিট রেটিং ইনফরমেশন অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (সিআরআইএসএল), ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড, ন্যাশনাল ক্রেডিট রেটিংস লিমিটেড, দ্য বাংলাদেশ রেটিং এজেন্সি লিমিটেড এবং ওয়াসো ক্রেডিট রেটিং কোম্পানি (বিডি) লিমিটেড।

তিনি তুলনা করে বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে এতগুলো এজেন্সি নেই। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে ৭টি, মালয়েশিয়ায় ২–৩টি, চীনে ৩–৪টি, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৩টি এবং থাইল্যান্ডে ২টি এজেন্সি রয়েছে।

ইতিহাস ও প্রসার

বাংলাদেশে ক্রেডিট রেটিং কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯২ সালে ক্রিসলের মাধ্যমে। ২০০৪–০৫ সালে মাত্র দুটি এজেন্সি কাজ করত: সিআরআইএসএল এবং সিআরএবি। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাসেল-২ ক্যাপিটাল অ্যাডেকোয়াসি ফ্রেমওয়ার্ক চালু করলে ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য এক্সটার্নাল ক্রেডিট অ্যাসেসমেন্ট ইনস্টিটিউশন (ইসিএআই) ব্যবহার করতে হয়। এর ফলে নতুন এজেন্সি অনুমোদনের জন্য আবেদন শুরু হয় এবং ২০০৯–১০ সালে আরও ৬টি এজেন্সি লাইসেন্স পায়।

অধ্যাপক হাসানের মতে, লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় কোনো বাজার সমীক্ষা বা আঞ্চলিক-বৈশ্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে বর্তমান ৮টি এজেন্সির মধ্যে প্রতিযোগিতা তীব্র হয়ে উঠেছে।

গুণমানের অবনতি ও ঝুঁকি

অধ্যাপক হাসান বলেন, “প্রয়োজনীয় কাজ না করার কারণে এজেন্সিগুলো টিকে থাকার জন্য ব্যাংকগুলোর সাথে আপস করে রেটিং দিচ্ছে। এর ফলে গুণমান এবং মূল্য যাচাইয়ে সঠিকতা নষ্ট হচ্ছে। ব্যাংকগুলো মানহীন রেটিং সত্ত্বেও উচ্চ রেটিং দেখাচ্ছে, যা তাদের মূলধন পর্যাপ্ততা বিপন্ন করছে।”

তিনি আরও বলেন, “বেশি এজেন্সির ফলে রেটিংয়ের নির্ভরযোগ্যতা হ্রাস পাচ্ছে, যা বন্ড বাজার ও ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপজ্জনক। এটি বিনিয়োগকারীর আস্থা নষ্ট করছে এবং কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট তৈরি করছে।”

সমাধানের আহ্বান

অধ্যাপক হাসান বিএসইসি ও বাংলাদেশ ব্যাংককে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “রেটিং এজেন্সিগুলোর সমস্যা সমাধান না করলে ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ততা বজায় রাখা অসম্ভব। নিয়ন্ত্রকদের কঠোরতা এবং বাজারভিত্তিক সমীক্ষা জরুরি।”

সেমিনারে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়নে বন্ড ও পুঁজিবাজারকে আরও কার্যকর করতে হবে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুরও সমস্যার স্বীকৃতি দিয়ে ব্যাসেল-৩ এর প্রস্তুতির কথা উল্লেখ করেন।

সেমিনারের পর বিএসইসি স্যালভো কেমিক্যালের শেয়ার ইস্যু বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা রেটিংয়ের গুরুত্ব তুলে ধরে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই সতর্কবাণী না মানলে বাংলাদেশের আর্থিক খাত আরও গভীর সংকটের মুখে পড়তে পারে।