বিএনপি-জামায়াত পৃথক পথে, অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি, কিন্তু ঝুঁকি রয়েছে

বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন: জোট গঠনের গোপন খেলায় বিএনপি-জামায়াতের পথবিভেদ, চারটি সম্ভাব্য জোটের ছায়া

বদিউল আলম লিংকন: শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানে নতুন সমীকরণ গড়ে উঠছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন (সম্ভাব্য ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে) ঘিরে জোট গঠনের গোপন আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে, কিন্তু দীর্ঘদিনের মিত্র বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে পথবিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বিএনপি বড় জোট গঠনের লক্ষ্যে ডান-বাম এবং উদারপন্থী দলগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করছে, যখন জামায়াত ইসলামপন্থী দলগুলোর সাথে পৃথক জোট বা আসন সমঝোতার দিকে ঝুঁকছে। এছাড়া, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বামপন্থী এবং অন্যান্য ইসলামি দলগুলোর মধ্যে অন্তত চারটি জোটের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপি অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে থাকলেও, জামায়াতের পুনরুত্থান রাজনীতিকে ডানপন্থী দিকে ঝুঁকিয়ে দিতে পারে।

জোট গঠনের পটভূমি: আন্দোলন থেকে নির্বাচনী কৌশল

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর (আগস্ট ২০২৪) রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের মুখ থেকে নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ঝুঁকেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন সংস্কার এবং নির্বাচনী তফশিল ঘোষণার অপেক্ষায় থাকলেও, দলগুলো পর্দার আড়ালে ভোটের হিসাব-নিকাশ শুরু করেছে। বিএনপি, জামায়াতসহ ২০টিরও বেশি ফ্যাসিবাদবিরোধী দলের নেতাদের সাথে আলোচনায় জানা গেছে, এককভাবে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা কম। বেশিরভাগ দল জোট বা আসন সমঝোতার উপর নির্ভর করবে।

ঐতিহাসিকভাবে, বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট (১৯৯৯-২০০৬) সরকার গঠন করলেও, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মতো ঘটনা তাদের সম্পর্কে ছায়া ফেলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের নির্বাচন বিলম্বের চেষ্টা (জুলাই চার্টার এবং সংস্কারের দাবিতে) বিএনপির সাথে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “জয়ের আস্থা থাকলে নির্বাচন কেন বিলম্ব করতে চান?” এদিকে, জামায়াত নেতা ডা. তাহের বলেছেন, “আমরা একটা জোট করছি, যেখানে বিএনপি থাকবে না।”

বিএনপির কৌশল: বড় জোট গঠনের লক্ষ্য

বিএনপি নির্বাচনকে ‘সহজ নয়’ বলে অভিহিত করে বড় জোট গঠনের দিকে ঝুঁকছে। দলটি আন্দোলনের সাথী দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যাবে এবং ডান-বাম-ইসলামি দলগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, “নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণার পর জোট নিয়ে আলোচনা করব। প্রয়োজনে জোট হবে, কিন্তু এখন সুনির্দিষ্ট কিছু বলা কঠিন।” বিএনপি এনসিপির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে এবং হেফাজতে ইসলাম থেকে কিছু অংশীদার নিতে পারে।

সম্ভাব্য অংশীদার: লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণফোরাম, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) নেতৃত্বাধীন ১২ দলীয় জোট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ১১টি দল, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য এবং বাংলাদেশ লেবার পার্টি।

জামায়াতের পৃথক পথ: ইসলামপন্থীদের একত্রিতকরণ

জামায়াতে ইসলামী এবার বিএনপির থেকে আলাদা হয়ে ইসলামপন্থী দলগুলোর সাথে জোট গঠন বা আসন সমঝোতার দিকে এগোচ্ছে। সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম বলেছেন, “ইসলামপন্থী দলগুলো যাতে এক জায়গায় থাকতে পারে, সে চেষ্টা চলছে। আলাপ-আলোচনা চলছে।” জামায়াতের সাথে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন এবং জাতীয় আন্দোলন (জাগপা) একত্রে আন্দোলন করছে। সাতটি ইসলামিস্ট দলের মধ্যে নির্বাচনী সংস্কারের দাবিতে র‍্যালি এবং প্রতিবাদের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

জামায়াতের পুনরুত্থান রাজনীতিকে ডানপন্থী করে তুলছে, এবং তারা এনসিপির সাথে জোট গঠন করে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। সাম্প্রতিক প্রতিবাদে (১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায়) জামায়াতের নেতৃত্বে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপিত হয়েছে, যাতে বিএনপি-বিরোধী অবস্থান স্পষ্ট। X-এ আলোচনায় বলা হচ্ছে, জামায়াত বিএনপির সাথে জোট না করে পৃথক শক্তি গড়তে চায়, যাতে পরবর্তী নির্বাচনে তারা ক্ষমতায় আসতে পারে।

অন্যান্য সম্ভাব্য জোট: চারটি জোটের ছায়াপাত

এনসিপি-কেন্দ্রিক জোট: উদারপন্থী দলগুলোর সাথে জোট গঠনের দিকে ঝুঁকছে।
বামপন্থী জোট: গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যসহ বাম দলগুলোর একটি জোট।
ইসলামি জোট: জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামপন্থীদের দ্বিতীয় জোট।
অন্যান্য: গণতন্ত্র মঞ্চসহ কয়েকটি দল নতুন উদ্যোগ নিয়েছে জুলাই চার্টার নিয়ে সংকট সমাধানের জন্য।

নির্বাচন কমিশনের তফশিল ঘোষণার পর (সম্ভবত অক্টোবরে) আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হবে।

বিশ্লেষকদের মতামত: অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি, কিন্তু ঝুঁকি রয়েছে

এদিকে, বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপির উচিত এই নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম বা ‘জেন জি’-এর চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া, কারণ তারা ভোটার শক্তি এবং রাজনৈতিক গতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধতা বিএনপিকে শক্তিশালী করেছে, কিন্তু জামায়াতের পৃথক পথ এবং ইসলামিস্টদের প্রতিবাদ রাজনীতিকে ডানপন্থী করে তুলতে পারে। গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে জুলাই চার্টার নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে, যা জোট গঠনকে জটিল করছে। X-এ আলোচনায় বলা হচ্ছে, বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক অর্থনৈতিক লেনদেনের উপর নির্ভর করে, কিন্তু জামায়াত বিএনপি-বিরোধী জোট গড়তে পারে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলছেন, সঠিক কৌশল না নিলে কোনো দল প্রত্যাশিত ফল পাবে না।

এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের চ্যালেঞ্জ তুলে ধরছে। নির্বাচন কমিশনের তফশিল ঘোষণার অপেক্ষায় রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা বাড়ছে।