রিজার্ভ চুরি: ফিলিপাইনের আরসিবিসি-তে রাখা ৮১ মিলিয়ন ডলার ফেরতের পথে
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলায় RCBC থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার বাজেয়াপ্ত: ৯ বছরের লড়াইয়ে নতুন মোড়।
টুইট ডেস্ক: ২০১৬ সালের বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাইবার হাইস্টের মামলায় নতুন গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলার (প্রায় ৯৮০ কোটি টাকা) ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন (RCBC) থেকে আদালতের নির্দেশে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
CID-এর বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) এই তথ্য নিশ্চিত করেন। এই বাজেয়াপ্তি ৯ বছরের আইনি লড়াইয়ের ফল, যা উত্তর কোরিয়ার লাজারাস গ্রুপের সন্দেহজনক হ্যাকিং থেকে শুরু হয়ে ফিলিপাইনের ক্যাসিনো খাতে অর্থ পাচারের মধ্য দিয়ে এসেছে।
২০১৬ সালের ৪-৫ ফেব্রুয়ারি রাতে অজ্ঞাত হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসাবে SWIFT নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ৩৫টি জালিয়াতি নির্দেশ পাঠান। এতে প্রায় ৯৫১ মিলিয়ন ডলার চুরি করার চেষ্টা হয়। ব্যাংকিং সিস্টেমের ফ্ল্যাগিং এবং একটি বানান ভুলের কারণে ৩০টি ট্রানজেকশন (৮৫১ মিলিয়ন ডলার) বন্ধ হয়। বাকি ৫টি সফল হয়, যাতে মোট ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়: ৮১ মিলিয়ন ফিলিপাইনে RCBC-এর চারটি অ্যাকাউন্টে এবং ২০ মিলিয়ন শ্রীলঙ্কার একটি ব্যাঙ্কে।
হ্যাকাররা উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্র-সমর্থিত লাজারাস গ্রুপের সদস্য বলে সন্দেহ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমে জানুয়ারি মাস থেকে ড্রাইডেক্স ম্যালওয়্যার ঢোকানো হয়েছিল। চুরি হওয়ার পর ফিলিপাইনের চীনা নববর্ষের ছুটির কারণে (৮ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশের স্টপ পেমেন্ট নোটিস RCBC-এ পৌঁছায়নি, যা অর্থ উত্তোলনের সুযোগ করে দেয়। RCBC-এর জুপিটার স্ট্রিট শাখায় চারটি কাল্পনিক নামের অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা হয়। পরে অর্থ ফিলিপাইন পেসোতে রূপান্তরিত হয় এবং ম্যানিলার ক্যাসিনোগুলোতে (যেমন সোলিয়ার ও মিডাস) পাচার করা হয়।
CID-এর জসীম উদ্দিন খান জানান, বাংলাদেশের আদালতের নির্দেশে RCBC থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এটি চুরির মোট অংশের পুরোটা, যা ফিলিপাইনের চারটি আলাদা অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়েছিল। পরবর্তী কর্মপন্থা (যেমন অর্থ ফেরত বা আইনি ব্যবস্থা) নির্ধারণের জন্য উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। পূর্বে ২০১৬ সালে ফিলিপাইন থেকে প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার পুনরুদ্ধার করা হয়। বাকি ৬৬ মিলিয়ন ক্যাসিনোতে হারিয়ে যায়, যার মধ্যে ৫০ মিলিয়ন সোলিয়ার ও মিডাস ক্যাসিনোতে লন্ডার হয়েছে।
আইনি এবং তদন্তের ইতিহাস: মামলা ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় দায়ের করা হয়। ফিলিপাইনে, RCBC-এর জুপিটার শাখার সাবেক ম্যানেজার মায়া ডেগুইটোকে ২০১৯ সালে ৮টি মানি লন্ডারিং অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং ৩২-৫৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে ফিলিপাইনের কোর্ট অফ অ্যাপিলস রায় কায়েম রাখে। RCBC-কে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৬ সালে ১ বিলিয়ন পেসো (প্রায় ৫২.৯২ মিলিয়ন ডলার) জরিমানা করে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৮-১৯ সালে RCBC-এর বিরুদ্ধে মামলা করে, যা নিউইয়র্ক কোর্টে চলতে থাকে।
সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৪-৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি হয়, যার মধ্যে ৮১ মিলিয়ন ফিলিপাইনের RCBC-তে স্থানান্তরিত হয়। সেই বছরের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ফিলিপাইন থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলার ফেরত আনা যায়। ২০১৬ সালের ৫ আগস্ট, ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক BSP RCBC-কে ৫২.৯২ মিলিয়ন ডলার জরিমানা করে। জানুয়ারি ২০১৯ সালে RCBC-এর জুপিটার শাখার সাবেক ম্যানেজার মায়া ডেগুইটোকে ৮টি মানি লন্ডারিং অভিযোগে ৩২ থেকে ৫৬ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এপ্রিল ২০২৩ সালে কোর্ট অফ অ্যাপিলস তার দোষী সাব্যস্ততা নিশ্চিত করে। সর্বশেষ, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে আদালতের নির্দেশে RCBC থেকে পুরো ৮১ মিলিয়ন ডলার বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
এই বাজেয়াপ্তি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভকে শক্তিশালী করবে এবং ২০১৬-এর হাইস্টের ক্ষতি পূরণে বড় স্বস্তি দেবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি সাইবার হাইস্ট থেকে শিক্ষা নেওয়ার স্মারক, যেমন SWIFT নিরাপত্তা উন্নয়ন এবং আন্তর্জনিক সহযোগিতা। CID-এর তদন্ত চলমান, এবং উচ্চপর্যায়ের মিটিংয়ে অর্থ ফেরতের প্রক্রিয়া নির্ধারিত হবে।
এই ঘটনা বিশ্বব্যাংকিংয়ে সাইবার হুমকির বিরুদ্ধে সতর্কতার বার্তা প্রদান করছে।