জাবেদ ও স্ত্রীর হাতে ইউসিবি: দুর্নীতির ২১৩ কোটি টাকার চাঞ্চল্যকর গল্প

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের বিরুদ্ধে ২১৩ কোটি টাকা ঘুষের চাঞ্চল্যকর অভিযোগ: দুদকের তদন্তে উন্মোচিত হয়েছে ‘ঋণ-ঘুষ’ চক্র

টুইট প্রতিবেদক: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরেকটি বিশাল চক্র উন্মোচিত হয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ‘জাবেদ’-এর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি বিশাল দুর্নীতি চক্র উন্মোচিত করেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাবেদ প্রভাব খাটিয়ে পাঁচটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ২১৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ঘুষ আদায় করেছেন। এই ঘুষ সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় তিনি নিজের স্ত্রী রুকমীলা জামানকে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) পিএলসির চেয়ারম্যান বানিয়ে ব্যাংকের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিলেন এবং ঋণ অনুমোদনের নামে ব্যবসায়ীদের ভয় দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।

তদন্ত নথি অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ১১ মে থেকে ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত রুকমীলা জামান ইউসিবি পিএলসির চেয়ারম্যান ছিলেন। তবে তিনি কখনো অফিসে যেতেন না; বরং জাবেদ নিজেই চেয়ারম্যানের কক্ষে বসে ব্যাংকের সকল সিদ্ধান্ত নিতেন। বোর্ড সভায়ও তিনিই সভাপতিত্ব করতেন এবং রেজ্যুলেশন ফাইলের স্বাক্ষর গুলশানের বাসা থেকে পিয়ন মাধ্যমে আনা হতো। এভাবে জাবেদ ব্যাংককে নিজের ব্যক্তিগত ‘ঘুষ সংগ্রহের যন্ত্র’ বানিয়ে ফেলেছিলেন।

প্রক্রিয়াটি ছিল সুনির্দিষ্ট: জাবেদ ব্যবসায়ীদের বাড়িতে ডেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দাবি করতেন। না দিলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে গুম করা, ব্যবসা বন্ধ করা বা অন্যান্য হুমকি দেওয়ার মতো কৌশল ব্যবহার করা হতো। পরে ব্যবসায়ীদের ঋণের আবেদন করিয়ে ইউসিবি থেকে অনুমোদন করাতেন এবং সেই ঋণের অর্থ চেক, নগদ বা ভাউচারের মাধ্যমে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হতো। এই চক্রে শুধুমাত্র ঘুষ নয়, অর্থপাচারের অভিযোগও রয়েছে।

দুদকের অনুসন্ধান নিশ্চিত করেছে যে নিম্নলিখিত পাঁচটি প্রতিষ্ঠান থেকে জাবেদ এই অঙ্ক আদায় করেছেন। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই ঋণ অনুমোদনের বিনিময়ে ঘুষের লেনদেন ঘটেছে।

থার্মেক্স নেট ইয়ার্ন – ৫২ কোটি টাকা; ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর ইউসিবি গুলশান অফিসে এমডি আব্দুল কাদের মোল্লাকে ৫০ কোটি টাকা দাবি করা হয়। চাপে ২৭ কোটি (নভেম্বর ২০২১) ও ২৫ কোটি (জুলাই ২০২২) প্রদান করা হয়। কাদের মোল্লা আদালতে মামলা করেছেন এবং তদন্তে সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে।

এইচ এম শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রিজ – ৫৫ কোটি টাকা; ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৩৫ কোটি + ২০ কোটি ঋণ অনুমোদন। চেকের মাধ্যমে ঘুষ নেওয়া হয় এবং পরে জাবেদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়।

ওয়াল মার্ট – ৫ কোটি টাকা; ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ২০ কোটি ঋণ অনুমোদন। ঋণের অংশ হিসেবে জাবেদের ঘনিষ্ঠ কর্মচারীর অ্যাকাউন্টে ৫ কোটি টাকা জমা হয়।

সাইফ পাওয়ারটেক ও ই-ইঞ্জিনিয়ারিং – ৪১.৭৫ কোটি টাকা; ২০২০ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ৩৫ কোটি ঋণ অনুমোদন। ২৯ কিস্তিতে চেক, নগদ ও ভাউচারের মাধ্যমে ঘুষ আদায় করা হয়।

বেস্ট সার্ভিস লিমিটেড – ৬০ কোটি টাকা; ২০২২ সালের জুনে ৬০ কোটি ঋণ অনুমোদন। নগদ উত্তোলন ও ২১টি ট্রানজেকশনের মাধ্যমে জাবেদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়।

মোট ঘুষের পরিমাণ ২১৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যা শুধুমাত্র এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের। দুদকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তদন্তের পরবর্তী পর্যায়ে আরও প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসতে পারে।

দুদক সূত্র জানিয়েছে, দুদকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানা গেছে, মামলার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে এবং আজই (২১ সেপ্টেম্বর) মামলা দায়ের করা হবে। পূর্ণাঙ্গ তদন্তে আরও অভিযোগ প্রকাশ পেতে পারে।

এই চক্রে শুধুমাত্র ঘুষ নয়, অর্থপাচারের অভিযোগও রয়েছে। দণ্ড নিশ্চিত হলে সাবেক মন্ত্রী ও তার সহযোগীদের জন্য বড় ধরনের আইনগত প্রভাব পড়তে পারে।