পাকিস্তান–সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তিতে ভারতের ঘুম হারাম!

পাকিস্তান-সৌদি কৌশলগত প্রতিরক্ষা চুক্তিতে ভারতের সতর্ক প্রতিক্রিয়া: জাতীয় নিরাপত্তার প্রভাব খতিয়ে দেখবে

টুইট প্রতিবেদক: সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মধ্যে গত ১৭ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষরিত ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ (Strategic Mutual Defence Agreement) দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই চুক্তিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, কোনো এক দেশের উপর আক্রমণকে উভয় দেশের বিরুদ্ধে যৌথ আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। https://www.facebook.com/share/v/1ChKFU8c6H/ বিস্তারিত ভিডিও।

এই চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার সতর্কতার সাথে এগোচ্ছে এবং এর জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং বিশ্বব্যাপী প্রভাব খতিয়ে দেখার ঘোষণা দিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (MEA) জানিয়েছে, এটি দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বোঝাপড়ার আনুষ্ঠানিক রূপ, কিন্তু ভারত জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সকল পদক্ষেপ নেবে।

চুক্তির বিবরণ

সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদের আল-ইয়ামামা প্রাসাদে মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) এই ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে প্রায় আট দশকের ঐতিহাসিক অংশীদারত্ব, ইসলামী ভ্রাতৃত্ব এবং যৌথ কৌশলগত স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।” চুক্তির মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও শক্তিশালী করা এবং যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যৌথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা।

একজন সিনিয়র সৌদি কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, “এটি একটি ব্যাপক প্রতিরক্ষা চুক্তি, যা সকল সামরিক উপায় অন্তর্ভুক্ত করে।” এতে পাকিস্তানের নিউক্লিয়ার ক্ষমতার সম্ভাব্য ব্যবহারের ইঙ্গিতও রয়েছে, যদিও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইশাক দার এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ সহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

শেহবাজ শরিফের রাষ্ট্রীয় সফরের সময় এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহায়তা, তেল সরবরাহ এবং সামরিক সহযোগিতার দীর্ঘ ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে। সৌদি আরব পাকিস্তানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, যেখানে ২.৫ মিলিয়নেরও বেশি পাকিস্তানি নাগরিক কাজ করে এবং অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করে।

আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট

এই চুক্তি এমন এক সময়ে স্বাক্ষরিত হয়েছে যখন মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা চরমে। ৯ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের কাতারের রাজধানী ডোহায় হামলা (হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে) এর পর আরব লীগ এবং ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (OIC)-এর যৌথ জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, যাতে ৬০টিরও বেশি দেশ অংশগ্রহণ করে। এই হামলা গাল্ফ দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা গ্যারান্টির উপর সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। সৌদি কর্মকর্তারা বলেছেন, চুক্তিটি কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার সাথে যুক্ত নয়, বরং দীর্ঘদিনের আলোচনার ফল।

এছাড়া, মে ২০২৫-এ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংক্ষিপ্ত সামরিক সংঘর্ষ (মিসাইল, ড্রোন এবং আর্টিলারি আক্রমণে ৭০ জনের মৃত্যু) এর পর এই চুক্তি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সৌদি আরব এই সংঘর্ষে মধ্যস্থতা করে উত্তেজনা কমাতে সাহায্য করেছিল বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চুক্তি পাকিস্তানকে পশ্চিম এশিয়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ফেলবে এবং গাল্ফ দেশগুলোর মার্কিন নির্ভরতা কমাতে সাহায্য করবে।

ভারতের প্রতিক্রিয়া

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল স্পোকসপারসন রণধীর জৈশ্বাল ১৮ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতিতে বলেছেন, “আমরা সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মধ্যে কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরের খবর দেখেছি। সরকার জানত যে এই উন্নয়ন, যা দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের ব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিক করে, আলোচনাধীন ছিল। আমরা এর আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব অধ্যয়ন করব। সরকার ভারতের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা এবং সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।” এই বিবৃতি এনডিটিভি এবং অন্যান্য ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

ভারতের উদ্বেগের কারণ হলো, এই চুক্তি পাকিস্তানকে সৌদি আরবের মতো শক্তিশালী অংশীদারের সমর্থন দিতে পারে, যা কাশ্মীর বা অন্যান্য সীমান্তবর্তী উত্তেজনায় প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদিও চুক্তিটি কাগজে পারস্পরিক বলে মনে হয়, বাস্তবে সৌদি আরব ভারতের সাথে তার শক্তিশালী সম্পর্ক (বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব এবং তেল আমদানি) ঝুঁকি নেবে না। হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “ভারত সরকার সকল পদক্ষেপ নেবে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় এবং ব্যাপক জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।”

ভারত-সৌদি সম্পর্ক

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে ভারত-সৌদি সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে শক্তিশালী হয়েছে। ভারত সৌদি আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার এবং তেলের তৃতীয় বৃহত্তম আমদানিকারক। মোদি তিনবার সৌদি সফর করেছেন এবং ২০১৬ সালে তাকে ‘কিং আব্দুল আজিজ স্যাশ’ নামক সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা প্রদান করা হয়। সৌদি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই চুক্তি ভারতের সাথে তাদের সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন আনবে না।

সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া এবং বিশ্লেষণ

এক্স (পূর্বের টুইটার)-এ এই চুক্তি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। কিছু ব্যবহারকারী বলছেন, “যদি ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করে, তাহলে সৌদি যোগ দেবে” – যা NATO-শৈলীর চুক্তির সাথে তুলনা করছে। অন্যরা বলছেন, “পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসী হামলাকে সৌদি-সমর্থিত হিসেবে দেখা উচিত।” বিশেষজ্ঞ ব্রহ্মা চেলানে বলেছেন, এটি মোদির পররাষ্ট্রনীতির একটি ‘অপ্রত্যাশিত ধাক্কা’। তবে, সৌদি কর্মকর্তারা জোর দিয়ে বলছেন, এটি কোনো নির্দিষ্ট দেশের বিরুদ্ধে নয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই চুক্তি দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা বাড়াতে পারে, বিশেষ করে কাশ্মীর ইস্যুতে। তবে, সৌদি-ভারতের অর্থনৈতিক বন্ধন এটিকে সীমিত করতে পারে। ভারত এখন এর প্রভাব মূল্যায়ন করে কৌশলগত পদক্ষেপ নেবে, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা বাড়ানো।

এই ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের পরিবর্তনশীল গতিপথকে ত্বরান্বিত করেছে, যেখানে গাল্ফ দেশগুলো নতুন অংশীদার খুঁজছে।
(সংবাদটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং ভারতীয় সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত।)