ভোরের আলোয় পাহাড়ি নারীদের হাটযাত্রা

বান্দরবান প্রতিনিধি | অসীম রায় (অশ্বিনী):

ভোরের প্রথম আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে শুরু হয় জীবিকার জন্য নারীদের এক বিশেষ যাত্রা।

প্রতিদিন কিংবা সাপ্তাহিক হাটের দিনে জীবিকার প্রয়োজনে তাঁরা আঁকাবাঁকা ও কাঁটাভরা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যান বাজারে। হাতে, মাথায় কিংবা কাঁধে বাঁশের ঝুড়ি ভর্তি দেশীয় ফলমূল, শাকসবজি, মসলা কিংবা বনজ পণ্য নিয়ে আসেন এসব নারী।

অতীতের অন্ধকার থেকে আলোর পথে

একসময় এই পথগুলো ছিল ভয়ের নামান্তর। চাঁদাবাজির দৌরাত্ম্য, সন্ত্রাসীদের উৎপাত এবং অস্থিরতার কারণে নারীরা হাটে আসতে সাহস করতেন না। বাজারে তাঁদের অংশগ্রহণও ছিল সীমিত। তবে সময়ের পালাবদলে এখন সেই অন্ধকার দিন পেছনে ফেলে নিশ্চিন্তে প্রতিদিনের হাটে কিংবা সাপ্তাহিক বড় বাজারে আসছেন পাহাড়ি নারীরা। তাঁদের উপস্থিতিতে আজকের হাট প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

সাপ্তাহিক হাটে জমজমাট পাহাড়ি পণ্য

রোববার ও বুধবার বান্দরবানের হাটগুলো রঙিন হয়ে ওঠে পাহাড়ি নারীদের আনা পণ্যে। বাজারজুড়ে সাজানো থাকে নানা রকম শাকসবজি—বুনো শাক, লাউ, চালকুমড়া, ঝিঙে, ঢেঁড়স, বন আলু, বাঁশ কোঁড়ল, কচুপাতা, কলমি শাক, পাহাড়ি শসা, পুদিনা, কচুর লতি, আদা, হলুদসহ আরও অনেক দেশীয় পণ্য। শুধু তাই নয়, কারও ঝুড়িতে দেখা যায় ব্যাঙ, শামুক, ঝিনুক কিংবা নাম না জানা বনজ উপাদানও।

অধিকাংশ পণ্য আসে পাহাড়িদের জুমচাষের ক্ষেত কিংবা আশপাশের বন থেকে। বাজারে পা রাখতেই ক্রেতাদের ভিড়। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে বেশির ভাগ পণ্য বিক্রি হয়ে যায়। স্থানীয়দের মন্তব্য—“পাহাড়িরা না এলে বাজার জমে না।”

নারীদের অভিজ্ঞতা

মিনু মারমা নামে এক পাহাড়ি নারী জানান, “আমরা হাটে আসামাত্রই ক্রেতারা ভিড় করেন। বেশি সময় বসে থাকতে হয় না; ঘণ্টার মধ্যেই সব বিক্রি হয়ে যায়।”

স্থানীয় শিক্ষক জাহেদ স্যার বলেন, “পাহাড়ি নারীদের সবজি সবসময় তাজা। তাঁদের উপস্থিতি ছাড়া বাজার প্রাণবন্ত হয় না। তাই সবাই আগ্রহ নিয়ে এসব কিনে নেন।”

পাহাড় থেকে শহরে

শুধু স্থানীয়রা নয়, শহরের ব্যবসায়ীরাও এসব পণ্য কিনে নিয়ে যান চট্টগ্রাম, ঢাকা ও দেশের অন্যান্য বড় শহরে। সেখানে পাহাড়ি সবজি ও বনজ পণ্যের জন্য আলাদা দোকানও আছে। মূলত শহরে বসবাসরত পাহাড়িদের চাহিদা মেটাতে হলেও বাঙালি ক্রেতারাও এখন এসব পণ্যে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

চট্টগ্রাম থেকে আসা ব্যবসায়ী আবদুল হক বলেন, “পাহাড়ি নারীদের আনা তাজা সবজি ও বনজ পণ্যের শহরে ব্যাপক চাহিদা আছে। আমরা সরাসরি পাহাড় থেকে কিনে শহরের দোকানে বিক্রি করি। এতে নারীরা ভালো দাম পান, আমরাও লাভবান হই।”

ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল, বিশেষ করে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে বহু বছর ধরেই পাহাড়ি নারীরা বাজার ব্যবস্থার অন্যতম চালিকাশক্তি। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও জুমচাষ, বনজ পণ্য সংগ্রহ ও বিক্রিতে সমান ভূমিকা রেখে আসছেন। তবে আশির ও নব্বইয়ের দশকে এই হাটগুলোতে ভয়, আতঙ্ক এবং সংঘাতের কারণে নারীদের অংশগ্রহণ কমে গিয়েছিল। সেই অস্থির সময় পার হয়ে আজ পাহাড়ি নারীরা আবারও হাটের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছেন।

তাঁদের প্রতিদিনের এই হাটযাত্রা শুধু জীবিকার সংগ্রাম নয়, বরং পাহাড়ের অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হাট মানেই শুধু লেনদেন নয়, বরং সামাজিক আড্ডা, তথ্য বিনিময় ও সম্পর্ক জোরদারের জায়গা।

আজ পাহাড়ি নারীদের দৃঢ় উপস্থিতিতে বাজার আবারও প্রাণবন্ত। পাহাড়ি তাজা শাকসবজি ও বনজ পণ্য স্থানীয় থেকে শুরু করে শহরের ক্রেতাদের মন জয় করছে প্রতিদিন।