তৈরি পোশাকসহ ৫ খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে

অর্থনীতি ডেস্ক: দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ এক বছরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন-২০২৪ অনুযায়ী, তৈরি পোশাক, বস্ত্র, চামড়া, নির্মাণ ও ব্যবসা-বাণিজ্য খাতে খেলাপির হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এর বাইরে জাহাজ নির্মাণ শিল্প খেলাপি ঋণের হারে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো মোট ১৭ লাখ ১১ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে তিন লাখ ৪৬ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২৫ শতাংশ। অথচ এক বছর আগে ২০২৩ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৩৩ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বা আট দশমিক ৯৪ শতাংশ। ফলে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে দুই লাখ ১২ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা।

২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ রেকর্ড পরিমাণে বেড়ে ৪,২০,৩৩৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৪.১৩%। এটি ২০২৪ সালের জুনে ২,১১,০০০ কোটি টাকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৪ সালের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পুনঃতফসিলকৃত ঋণের মধ্যে ৩৮.৫% আবারও খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা ২০২৩ সালের ১৮% থেকে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।

এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিবেদন মান (IFRS-9) অনুযায়ী নতুন প্রভিশনিং মডেল চালু করেছে, যা ঋণের ক্রেডিট ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ পূর্বাভাসের ভিত্তিতে প্রভিশন নির্ধারণ করে।

এছাড়া, ব্যাংকিং খাতের মূলধন-ঝুঁকি-সম্পর্কিত সম্পদ অনুপাত (CRAR) ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ৩.০৮% এ নেমে এসেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম।

এই পরিস্থিতি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ব্যাংকিং খাতের স্বাস্থ্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে, এবং শক্তিশালী সংস্কার ও নজরদারির প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়েছে।

তৈরি পোশাক খাত :

২০২৪ সালে তৈরি পোশাক খাতে ঋণ বিতরণ হয়েছে এক লাখ ৮৮ হাজার ২৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ৪৮ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা বা ২৫ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এক বছর আগে এ হার ছিল মাত্র ১৩ দশমিক ৮৮ শতাংশ (২২ হাজার ৭০২ কোটি টাকা)। ফলে এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা (১১৪ শতাংশ বৃদ্ধি)। এ খাত খেলাপি হারে এখন চতুর্থ স্থানে।

বস্ত্র খাত :

গত বছর শেষে বস্ত্র খাতে ঋণ দাঁড়ায় এক লাখ ৪৯ হাজার ১৭১ কোটি টাকা। খেলাপি হয়েছে ৩৬ হাজার ৫২০ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এক বছর আগে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১৫ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা (১১ দশমিক ৭৯ শতাংশ)। খেলাপি বেড়েছে ২১ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। এ খাত এখন পঞ্চম স্থানে।

নির্মাণ খাত :

নির্মাণ খাতে খেলাপি ঋণ এক বছরে সাত হাজার ৬৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৬ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা বা ২৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। বৃদ্ধির পরিমাণ ১৯ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। খেলাপি হারে খাতটি তৃতীয় স্থানে।

চামড়া খাত :

চামড়া খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা বা ৩৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আগের বছর এ খাতে খেলাপি ছিল ২ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা (২১ দশমিক ২৭ শতাংশ)। অর্থাৎ, এক বছরে খেলাপি বেড়েছে প্রায় ২ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। খেলাপি হারে খাতটি দ্বিতীয় স্থানে।

ব্যবসা-বাণিজ্য খাত :

খেলাপির অঙ্কে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি দেখা গেছে এ খাতে। ২০২৪ সালের শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা বা ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে এটি ছিল ৩০ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা (১২ দশমিক ০৭ শতাংশ)। অর্থাৎ, এক বছরে খেলাপি বেড়েছে ৫৭ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা।

অন্যান্য খাতের চিত্র

জাহাজ নির্মাণ খাত : খেলাপি ঋণ ৮ হাজার ৩১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ ঋণের ৩৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। খেলাপি হারে এটি এখন শীর্ষে।

কৃষি খাত : খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৭ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা (১০ দশমিক ৯৯ শতাংশ)।

কৃষিভিত্তিক শিল্প : খেলাপি দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজার ২১ কোটি টাকা (১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ)।

গৃহঋণ : খেলাপি বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৭৫ কোটি টাকা (১১ দশমিক ৭২ শতাংশ)।

ব্যক্তি ঋণ : খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা (১১ দশমিক ৮৬ শতাংশ)।

খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খেলাপি বাড়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে—মেয়াদি ঋণের সময় পুনর্নির্ধারণ, বড় গ্রাহকদের খেলাপি হিসেবে চিহ্নিতকরণ, চলতি ঋণ নবায়ন না হওয়া, পুনঃতফসিল ঋণ আবার খেলাপি হওয়া, এবং বিদ্যমান খেলাপি ঋণের বিপরীতে সুদ আরোপ।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানা সুবিধা ও নীতির কারণে প্রকৃত খেলাপি ঋণের চিত্র আড়াল করা হয়েছিল। প্রভাবশালী গ্রুপগুলো ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা তুললেও সেগুলোকে নিয়মিত দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক সেই সুবিধা ও নীতি থেকে সরে আসে। ফলে খেলাপি কম দেখানোর সুযোগ বন্ধ হওয়ায় প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে এসেছে।