গভর্নর মনসুর: ব্যাংক খাতে ঐতিহাসিক সংস্কার শুরু, দুর্বল ব্যাংকও একীভূত হবে

সাক্ষাৎকারে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর: ব্যাংক খাতে ঐতিহাসিক সংস্কার শুরু, দুর্বল ব্যাংকও একীভূত হবে

টুইট ডেস্ক: বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, দেশের ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এই উদ্যোগের আওতায় দুর্বল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোও একীভূত করা হবে বলে জানান তিনি।

ব্যাংক খাত সংস্কারে ছয়টি নতুন আইন

ড. মনসুর বলেন, “ব্যাংক খাতের সংস্কারের জন্য আমরা ইতোমধ্যে রূপরেখা তৈরি করেছি এবং সেই অনুযায়ী কাজ শুরু করেছি। ছয়টি আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছি। এর মধ্যে ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্ট ইতোমধ্যে পাশ হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার’ সংশোধন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে যাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একইসঙ্গে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে পরিচালক থাকা মেয়াদ ১২ বছর থেকে কমিয়ে ৬ বছর করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং স্বতন্ত্র পরিচালক ৫০% করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

মানি লন্ডারিং ও দুর্বল বিচারব্যবস্থা

গভর্নর অভিযোগ করেন, দেশের আর্থিক খাতে বিচারব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। হাইকোর্টের রিটের কারণে অনেক ব্যাংকের টাকা আটকে আছে। তিনি বলেন, “বিশ্বের কোথাও এভাবে রিট দিয়ে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয় না। এটা বন্ধ করতে হবে।”

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে চারটি সংস্থা নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাস্কফোর্স পাচার হওয়া অর্থ দেশের ভেতরে ও বাইরে চিহ্নিত করে আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছে।

ঋণ শ্রেণিকরণে আন্তর্জাতিক মান

বাংলাদেশের ঋণমান শ্রেণিকরণ পদ্ধতি আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে আসা হয়েছে উল্লেখ করে গভর্নর বলেন, “এতদিন ছয় মাস ও নয় মাস ভিত্তিক পদ্ধতি চালু ছিল, যা আন্তর্জাতিক মানের নয়। এখন থেকে তিন মাস ভিত্তিক শ্রেণিকরণ চালু করা হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “ঋণ না দেওয়ার একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যেখানে অনেকে ১৫ বছর আগের ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা নিয়ে যাচ্ছেন। এই চক্র ভাঙতেই পরিবর্তন আনা হয়েছে।”

ব্যবস্থাপনায় কঠোরতা: ১৪টি ব্যাংকের বোর্ড বাতিল

গভর্নর বলেন, “আমরা ইতোমধ্যে ১৪টি ব্যাংকের বোর্ড ভেঙে দিয়েছি। এসব ব্যাংককে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। যদি কোনো অনিয়ম বা ব্যত্যয় হয়, সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করবে।”

বোর্ড ভেঙে দেওয়া ১৪টি ব্যাংকের রয়েছে-১. ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, ২. সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ৩. গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ৪. ইউনিয়ন ব্যাংক পিএলসি, ৫. ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ৬. বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড, ৭. আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, ৮. ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), ৯. এক্সপোর্ট ইমপোর্ট (এক্সিম) ব্যাংক পিএলসি, ১০. আইএফআইসি ব্যাংক পিএলসি, ১১. ন্যাশনাল ব্যাংক পিএলসি, ১২. মেঘনা ব্যাংক পিএলসি, ১৩. এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক (এনআরবিসি) পিএলসি, ১৪. এনআরবি ব্যাংক পিএলসি।

তিনি বলেন, “কোনো ব্যাংকের এমডিকে অন্যায়ভাবে অপসারণ করা হলে বোর্ড ভেঙে দেওয়া হবে।”

রাজনৈতিকভাবে অনুমোদিত ব্যাংকেও সুশাসনের উদ্যোগ

ড. মনসুর দাবি করেন, আগের সরকার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে পরিবারভিত্তিক কিছু ব্যাংক অনুমোদন দিয়েছিল। এই ব্যাংকগুলোতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতেই বাংলাদেশ ব্যাংকে আলাদা ব্যাংক রেজুলেশন ডিপার্টমেন্ট গঠন করা হয়েছে।

ফ্যাক্টরি বন্ধ ও এলসি প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা

তিনি বলেন, “এই সরকার কারো ফ্যাক্টরি রাজনৈতিক কারণে বন্ধ করেনি। শুধুমাত্র বেক্সিমকোর একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে, যেটি তারা নিজেরা চালাতে পারছিল না। সরকারের পক্ষ থেকে প্রথম তিন মাসের বেতন দেওয়া হয়েছে এবং পরবর্তী তিন মাস পরে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়।”

তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কারো এলসি বন্ধ করেনি, বরং যাদের বন্ধ ছিল, তাদের জন্য এলসি খোলার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ব্যক্তিগত লকার বাংলাদেশ ব্যাংকে থাকবে না

গভর্নর বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকে ব্যক্তিগত লকার বন্ধ করে দেওয়া হবে। যদিও কিছু ফ্রিজ করা লকারের কারণে তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করা যাচ্ছে না, তবে নীতিগত সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যেই নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে শুধু বেসরকারি ব্যাংকে লকার থাকবে।”

সুদের হার কমানোর পরিকল্পনা

মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে আসায় আগামীতে সুদের হার কমানো হবে বলে জানান গভর্নর। তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি ৭%-এর নিচে নামলে, সম্ভবত ৩% পর্যন্ত নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।”

ডলার বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরানো

তিনি বলেন, “আমরা দায়িত্ব নেওয়ার সময় দেশে চরম ডলার সংকট ছিল। আমরা বড় আমদানিকারকদের কাছ থেকে ডলার নিয়ে অন্যান্যদের মাঝে বণ্টন করেছি এবং মার্কেট নির্ধারিত রেটে ডলার চালু করেছি।”

তিনি আরও জানান, “বাজারকে ছেড়ে দিলেও, ডলার রেট এখন স্থিতিশীল। এতে মূল্যস্ফীতি কমাতেও সহায়তা মিলেছে।”

রিজার্ভ চুরি মামলা: শুনানি সেপ্টেম্বরে

রিজার্ভ চুরির মামলার বিষয়ে গভর্নর বলেন, “আগামী সেপ্টেম্বর মাসে হিয়ারিং হবে। আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, আমাদের পক্ষে রায় আসতে পারে। এছাড়া দেশের তদন্ত সংস্থাগুলো আলাদাভাবে বিষয়টি দেখছে।”

সম্মানজনক বিদায় চান গভর্নর

সাক্ষাৎকারের শেষভাগে গভর্নর বলেন, “আমি সব সময় সংকটের মধ্য দিয়ে পথ চলেছি। এবার সরকারে থেকে কাজের সুযোগ পেয়েছি। আমি চাই, এটা হোক আমার শেষ দায়িত্ব, যাতে মাথা উঁচু করে সম্মানের সঙ্গে বিদায় নিতে পারি।”