রাজশাহী মেডিক্যালে লা’শবাহী অ্যাম্বুলেন্সে সিন্ডিকেটের দাপট

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের সামনে গড়ে উঠেছে একটি দুর্বৃত্তচক্র, যারা রোগী ও লাশ পরিবহনের নামে রোগীর স্বজনদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করছে। এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে শুধু রোগীই নয়, মৃতদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রেও স্বজনরা চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

চব্বিশনগর এলাকার জাহিদুল ইসলাম (৪০) গতকাল দুপুর ১২টার দিকে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। এরপর মরদেহ বাড়িতে নিতে গেলে হাসপাতালের সামনে অবস্থান করা অ্যাম্বুলেন্স চালকরা মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য ৫ হাজার টাকা ভাড়া দাবি করেন। বাধ্য হয়ে স্বজনরা ৪ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেন।

জাহিদুলের স্বজন আরিফুল ইসলাম জানান, নিজেরা একটি মাইক্রোবাস ভাড়া করে মরদেহ নিতে চাইলেও তা আটকে দেয় সিন্ডিকেট। তারা জানায়, ‘সমিতির বাইরে কোনো গাড়ি মরদেহ বহন করতে পারবে না, করলে সমিতিকে ২ হাজার টাকা দিতে হবে।’ না হলে মরদেহ তারা ছাড়বে না বলে হুমকি দেয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই রামেক হাসপাতালকে কেন্দ্র করে সক্রিয়। বাইরের অ্যাম্বুলেন্স বা গাড়িকে রোগী বা মরদেহ পরিবহন করতে দেওয়া হয় না। সিন্ডিকেটটি নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং আওয়ামী লীগ নেতা জানে আলম জনি। একসময় হাসপাতালের মজুরিভিত্তিক কর্মচারী ছিলেন তিনি। বর্তমানে অন্তত ৩০টি অ্যাম্বুলেন্সের মালিক তিনি। তাঁর ভাগ্নে সাদ্দাম হোসেনের মাধ্যমে পুরো সিন্ডিকেট পরিচালিত হয়।

সাদ্দামের মালিকানায় রয়েছে আরও পাঁচটি অ্যাম্বুলেন্স। সিন্ডিকেট পরিচালনায় তাঁকে সহায়তা করেন ডালিম, জনি হোসেন, সুমন, বাদশা, ইমন এবং আঁকা। এদের অনেকেরই নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে, বাকিরা চালক হিসেবে যুক্ত।

সিন্ডিকেটের কারণে বাইরে থেকে আসা কোনো অ্যাম্বুলেন্সে রোগী নেওয়া যায় না। পাবনার ঈশ্বরদী থেকে আসা হাবিবুর রহমান জানান, তিনি তাঁর রোগীকে নিজ এলাকা থেকে আসা একটি অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যেতে চাইলেও বাধা দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে তিনি ৩ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে হাসপাতালের সিন্ডিকেটের অ্যাম্বুলেন্সে রোগী নিয়ে যান—যেখানে তার প্রকৃত খরচ হতো দেড় হাজার টাকারও কম।

রামেক হাসপাতালের বর্হিবিভাগে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ৩০-৩৫টি পুরনো, ফিটনেসবিহীন অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে রয়েছে। চালকরা হাসপাতালের গেট ও আশপাশে ঘুরে ঘুরে স্বজনদের টানছেন। হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের এক নেতা জানান, এই সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে ডাক্তাররাও কিছু করতে পারছেন না।

হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, “আমার দাদা মারা যাওয়ার পর নিজের গাড়িতে মরদেহ নিতে পারিনি। জোর করে তাদের ভাঙাচোরা অ্যাম্বুলেন্সে ভাড়া দিয়ে মরদেহ নিয়ে যেতে হয়েছে। এটা অমানবিক।”

রামেক হাসপাতালের পুলিশ বক্স ইনচার্জ এএসআই আকরাম হোসেন জানান, তিনি সদ্য যোগ দিয়েছেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই।

এ বিষয়ে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহমেদ বলেন, “এই সিন্ডিকেট অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমি বিষয়টি জানি এবং এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। খুব শিগগিরই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”