বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবার অগ্রগতি: প্রেক্ষিত কমিউনিটি ক্লিনিক
এম বি আলম : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্ভাবিত ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ প্রকল্পটি উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চিকিৎসা সুযোগ নিয়েছে। সিলেট জেলার ৪টি উপজেলার ৮৬টি কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রযোজ্য এই সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ উন্মুক্ত হয়েছে।
এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলি গ্রামীণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষকে বিনামূল্যে ওষুধ প্রদান করে থাকে এবং স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে সম্প্রতি উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ প্রদানে যোগ হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় সিলেট জেলার ৪টি উপজেলার ৮৬টি কমিউনিটি ক্লিনিকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ যোগ হয়েছে।
মানুষকে নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার এ পর্যন্ত সারা দেশে পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বে ১৪ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছে।
উচ্চ রক্তচাপের জন্য এমলোডিপিন ৫ মিলিগ্রাম ও ডায়বেটিসের জন্য মেটফরমিন ৫০০ মিলিগ্রাম ওষুধ সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত হয়। সিলেট জেলার ৪টি উপজেলার ৮৬টি কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রযোজ্য এই সুযোগ উন্মুক্ত হয়েছে। এছাড়া, বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ওষুধগুলি আগামী বছর থেকে দেশের প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে বিনামূল্যে পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্ভাবিত ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ প্রকল্পটি বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে অনেক আগেই বিশ্বের দরবারে উল্লেখযোগ্য হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষকে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ প্রদান করা হয়েছে এবং সম্প্রতি উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ যোগ হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার উন্নতমানের লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চালু করেছেন, যা সব মানুষের দোরগোড়ায় সারাদেশে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে বিপ্লব ঘটিয়েছে। আর অসংক্রামক রোগের মত, জনগণের চাহিদার মোকাবিলার জন্য সরকার কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধের তালিকায় উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের ওষুধ যোগ করেছে।
উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অসংক্রামক রোগ মোকাবিলার জন্য এই প্রকল্পটি স্বাগতপূর্ণ এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।
উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ প্রদানের এই উদ্যোগটি একটি সহায়ক হতে পারে এবং এই প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে । সম্প্রতি বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের মতো কষ্টসাধ্য রোগ।
বাংলাদেশে প্রতি ৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজনের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ দেওয়ার সিদ্ধান্ত এই রোগের চিকিৎসায় কার্যকরী এবং ব্যয়-সাশ্রয়ী পদক্ষেপ হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। স্থ্যসেবা সারা দেশের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।
গত দুই দশকে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবা সংক্রান্ত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছে, এমডিজি-৪ অর্জন করেছে। এখন, সিবিএইচসি এর পোষ্য অধীনে এসডিজি এবং ইএসডি কার্যক্রম চলছে। এসডিজি হিসাবে সিবিএইচসি এর অর্জন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং ২০৩০ সালে এসডিজির অর্জন অব্যাহত থাকতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আয়োজিত ১৯৭৮ সালের আলমা-আটা শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশ অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ। আলমা আটার ঘোষণা ছিল প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার মাধ্যমে “২০০০ সনের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য”। কিন্তু ১৯৯৬ সনের সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ লক্ষ্যের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর উন্নয়ন চিন্তায় পরিবর্তন আসে। এসময় গ্রামীণ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মানসম্মত প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। মূলত জনগণের অংশগ্রহণে গ্রামীণ মানুষের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা পৌঁছে দেওয়াই ছিল লক্ষ্য।
কমিউনিটি ক্লিনিক হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তা প্রসূত একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কার্যক্রম যা Community Based Health Care (CBHC) অপারেশনাল প্ল্যান এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং বর্তমান সরকারের সাফল্যের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত যা দেশে-বিদেশে নন্দিত।
এ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত গ্রামীণ জনগণ নিকটস্থ কমিউনিটি ক্লিনিক হতে সমন্বিত স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টি সেবা পাচ্ছেন। এটি জনগন ও সরকারের যৌথ প্রয়াসে বাস্তবায়িত একটি কার্যক্রম। জনমূখী এ কার্যক্রম ১৯৯৬ সালে গৃহীত হয় যার বাস্তবায়ন শুরু হয় ১৯৯৮ সালে।
২৬ এপ্রিল ২০০০ সালে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গীপাড়া উপজেলার পাটগাতী ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধনের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা কার্যক্রমের শুভ সূচনা করেন।
১৯৯৮-২০০১ সময়ে ১০০০০ এর অধিক কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মিত ও অধিকাংশই চালু করা হয় এবং জনগণ সেবা পেতে শুরু করে। কিন্তু ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর এ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং এ অবস্থা ২০০৮ সাল অবধি চলমান থাকে।
দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় নদীভাংগন ও অন্যান্য কারণে ৯৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১০৬২৪টি বিদ্যমান থাকে। পরবর্তীতে ২০০৯ সাল হতে Revitalization of Community Health Care Initiativs in Bangladesh (RCHCIB) শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক পুনঃরুজ্জীবিতকরণ কার্যক্রম শুরু হয়।
এ কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৯৯৮-২০০১ সময়ে নির্মিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলির প্রয়োজনীয় মেরামত, জনবল পদায়ন, ঔষধ ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ পূর্বক এবং নতুন নির্মিত কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যায়ক্রমে চালু করা হয়। এটি ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
কমিউনিটি ক্লিনিক পূনঃরুজ্জীবিতকরণের শুরু হতেই স্বাস্থ্য সেবার মূলধারার সাথে সমন্বয় রেখে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মকান্ড মাধ্যমে স্বাস্থ্য সেবার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই ২০১১ হতে RCHCIB প্রকল্পের পাশাপাশি HPNSDP এর আওতায় Community Based Health Care (CBHC) অপারেশনাল প্ল্যান এর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। RCHCIB প্রকল্পের মেয়াদ অন্তে জুলাই ২০১৫ হতে CBHC অপারেশনাল প্ল্যান এর মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিক এর সকল কার্যক্রম বাস্তবায়িত হয়েছে যা ডিসেম্বর ২০১৬ তে সমাপ্ত হয়েছে।
বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে ৪র্থ সেক্টর (৪র্থ এইচপিএনএসপি) কর্মসূচিতে Community Based Health Care (CBHC) অপারশেনাল প্ল্যান জানুয়ারি ২০১৭ হতে জুন ২০২৩ মেয়াদে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
উল্লখ্যে যে, কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমকে গতিশীল ও টেকসই করার লক্ষ্যে মহান জাতীয় সংসদে ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট বিল পাশ হয়। অতঃপর মহামান্য রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে ৮ অক্টোবর ২০১৮ আইনটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয় (২০১৮ সালের ৫২ নং আইন)। এই আইনের বলে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের আওতাধীন Community Based Health Care (CBHC) অপারশেনাল প্ল্যানের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহ পরচালিত হচ্ছে।
এসডিজি সম্পৃক্ততা : ২০৩০ সালের মধ্যে সব বয়সের সকল মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ও কল্যাণ নিশ্চিত করা। কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমে মূল উদ্দেশ্য; লক্ষ্যমাত্রা: স্বাস্থ্য সম্পর্কিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৩টি সূচকের মধ্যে বেশীরভাগই কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে ৩.৮ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিসেবা (Essential Service Package) সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রাটি কমিউনিটি ক্লিনিকের সাথে বিশেষভাবে সম্পর্কিত।
২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গঠন এবং সুস্থ সবল রোগমুক্ত সচেতন কর্মক্ষম জাতি গঠনই কমিউনিটি ক্লিনিক-এর মূল ভিশন।