ঐকমত্য কমিশন ‘টার্গেট করছে’ দলীয় নেতৃত্বকে! কার লাভ, কার ক্ষতি?

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে বিএনপির আপত্তি: গণতন্ত্রবিরোধী বলে সমালোচনা

ব‌দিউল আলম লিংকন: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাম্প্রতিক গঠনতান্ত্রিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

বিশেষ করে, একজন ব্যক্তি যেন দলীয় প্রধান, সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী—এই তিনটি পদে একযোগে থাকতে না পারেন, এমন প্রস্তাবকে তারা ‘গণতন্ত্রবিরোধী’ এবং ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

বিএনপি বলছে, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে মূলত বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করাই উদ্দেশ্য।

সোমবার (২১ জুলাই) রাতে গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

বৈঠকে বিএনপি সিদ্ধান্ত নেয়, ঐকমত্য কমিশনের জাতীয় সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেবে তারা।

বিএনপির যুক্তি ও প্রতিক্রিয়া

স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বৈঠকে বলেন, বিশ্বের বহু গণতান্ত্রিক দেশে (যেমন—যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত) দলীয় প্রধানরাই সরকারপ্রধান হন। বাংলাদেশের ইতিহাসেও এমন উদাহরণ রয়েছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন:

“সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সেই দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হবেন—এটাই গণতন্ত্রের রীতি। এটা রোধ করার মাধ্যমে কমিশন সাংবিধানিক অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ করছে।”

কমিটির আরও সদস্যরা বলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে আলোচনা জরুরি হলেও, প্রধানমন্ত্রী পদে বাস্তবক্ষমতা না থাকলে সংসদীয় পদ্ধতি অর্থহীন হয়ে পড়বে।

ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব

গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর, গণআন্দোলনের পর রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কারে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়। এর নেতৃত্বে আছেন প্রধান উপ‌দেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সংবিধান, নির্বাচন, বিচার, পুলিশ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতিবিরোধী কমিশন—এই ছয়টি উপকমিশনের সমন্বয়ে গঠিত এই বড় কমিশন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো নির্ধারণে কাজ করছে।

২১ জুলাই কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের ১৬তম বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সহ বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। ঐ বৈঠকেই বিতর্কিত এই প্রস্তাব আসে।

কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন:

“সব দলের ঐক্যমত্য সব জায়গায় নাও হতে পারে। তবে গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের স্বার্থে সংলাপ ও আলোচনার দরজা খোলা রাখতে হবে।”

রাজনৈতিক উত্তাপ: কার লাভ, কার ক্ষতি?

বিশ্লেষকদের মতে, কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপি, কারণ তাদের মূল নেতৃত্বকে কার্যত প্রধানমন্ত্রিত্বের বাইরে রাখা হবে। অপরদিকে, এর রাজনৈতিক সুবিধা পেতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বা যে দল বর্তমানে প্রভাবশালী জোটে থাকবে।

তবে এই প্রস্তাব শুধু বিএনপি নয়, জামায়াত ও এনসিপিও প্রত্যাখ্যান করেছে। জামায়াতের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন গঠনে আওয়ামী লীগের প্রণীত আইনের বিরোধিতা করা হয়েছে। এনসিপি নেতা আখতার হোসেন বলেন, “বিএনপি নিজেই সংস্কারে বাধা দিচ্ছে”—যা আবার বিতর্ককে আরও ঘনীভূত করেছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ও বিএনপির তীব্র আপত্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। একদিকে কমিশন একটি সমন্বিত সংস্কারের মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্র কাঠামো দাঁড় করাতে চায়,

অন্যদিকে বিএনপি এটিকে গণতন্ত্র ও দলীয় নেতৃত্বের ওপর ‘নিয়ন্ত্রণমূলক হস্তক্ষেপ’ হিসেবে দেখছে।

সামনের দিনগুলোতে এই দ্বন্দ্ব কতটা তীব্র হয়, তা নির্ভর করবে কমিশনের চূড়ান্ত প্রস্তাব এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়ার ওপর।

সম্ভাব্য সমাধান

বিএন‌পি যদি আলোচনায় যায়-তবে প্রস্তাব রাখ‌তে পারেন বা বিএনপির করণীয়

১. জনগণের রায়কে প্রাধান্য দেওয়া
সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা যেতে পারে—সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া দলের মনোনীত নেতাই প্রধানমন্ত্রী হবেন। এতে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও দলীয় স্বাধীনতা বজায় থাকবে।

২. একটি সময়সীমা নির্ধারণ করা
কেউ যদি একইসঙ্গে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী হন, তবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর দলীয় নেতৃত্ব অন্য কাউকে দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। এতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ হবে।

৩. গঠনমূলক সংলাপ ও জাতীয় সম্মেলন
কমিশন, রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণে একটি উন্মুক্ত সংলাপ আয়োজনের মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হতে পারে।

অন‌্যদি‌কে বিএন‌পি‌কে-

১. ‘নোট অব ডিসেন্ট’ এর মাধ্যমে প্রস্তাব লিখিতভাবে চ্যালেঞ্জ করা।

জাতীয় সনদে আনুষ্ঠানিকভাবে ভিন্নমতের যুক্তিসংবলিত বিবৃতি জমা দিতে হবে, যাতে তা ভবিষ্যতে নথিভুক্ত থাকে।

২. দলীয় কর্মসূচিতে সচেতনতা সৃষ্টি করা।

জনগণের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে মত তৈরি করতে গণসংযোগ, সেমিনার, সামাজিক মাধ্যম ও প্রচারণা চালানো দরকার।

৪. সমঝোতার জন্য প্রস্তুত থাকা, কিন্তু নতি স্বীকার নয় ।

সংলাপ ও আলোচনায় প্রস্তুত থাকতে হবে, কিন্তু দলের নীতি ও আদর্শ বিসর্জন না দিয়ে অবস্থান সুসংহত রাখতে হবে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিতর্কিত প্রস্তাব বিএনপিকে রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও নেতৃত্বের প্রশ্নে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এই পরিস্থিতিতে দলের শক্তিশালী যুক্তিনির্ভর অবস্থান, সংবিধানসম্মত সমাধানের প্রস্তাব, এবং জনগণের মত প্রভাবিত করার কৌশলগত কার্যক্রম এখন জরুরি।

রাজনৈতিক সংকট নয়, গঠনমূলক সংলাপ ও যৌক্তিক অবস্থানই হতে পারে ভবিষ্যৎ উত্তরণের পথ।