বিমানের আগুন থে‌কে জীবন রক্ষার যুদ্ধ: সেই তিন মিনিটের বিভীষিকা

শিক্ষক মোহাম্মদ সায়েদুল আমীনের বিবরণে রচিত

টুইট ডেস্ক: দুপুর গড়িয়ে তখন প্রায় একটা। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্লাস শেষ হয়ে গেছে। ইংরেজি মাধ্যমের দোতলায় শিক্ষক মোহাম্মদ সায়েদুল আমীন তখনো আটকে ছিলেন সাত-আটজন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রসহ।

হঠাৎ যেন আকাশ কেঁপে উঠল। বিকট শব্দ। প্রথমে ভেবেছিলেন বজ্রপাত, কিন্তু মুহূর্তেই ভুল ভাঙল। পাশের নারকেলগাছে আগুন! সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ল দোতলার বারান্দা ও কক্ষজুড়ে। ধোঁয়ায় দমবন্ধ অবস্থা—এক বিভীষিকা নেমে এল হঠাৎ।

বিমানের বিধ্বস্ত হওয়ার মুহূর্তে ভবনের পশ্চিম পাশের একটি কক্ষে ছিলেন সায়েদুল আমীন। ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে আশ্রয় নিলেন ওয়াশরুমে। জানতেন, ধোঁয়ার মধ্যে বেশিক্ষণ টিকে থাকা যাবে না। হঠাৎ মনে পড়ল, পাশের বারান্দায় একটি লোহার পকেট গেট আছে—তবে সব সময় তালা দেওয়া থাকে। সে দিনও তালা দেওয়া ছিল। কিন্তু জীবনের প্রশ্নে এখন দরজা ভাঙতে হবে!

ছাত্ররা আতঙ্কে চিৎকার করছে—“স্যার বাঁচান!” নিজের সন্তানের মতো ছাত্রদের মুখের দিকে তাকাতে পারছিলেন না তিনি। বাইরে থেকে আগুন ধেয়ে আসছে, ভেতরে নিঃশ্বাস নেওয়া দুষ্কর। এরই মধ্যে বারান্দা দিয়ে এক ছাত্র দৌড়ে এল, গায়ে আগুন। আকুতি—“স্যার আমাকে বাঁচান!” সেই সময় তার শার্টে আগুন, সায়েদুল স্যার যখন ধরলেন, তখন তার হাতও পুড়ে যাওয়ার জোগাড়।

পাশে থাকা ছাত্রদের বললেন, পানি ঢালতে। আর তিনি মরিয়া হয়ে গেট ভাঙতে লাগলেন—লাথি দিয়ে, ঘুষি দিয়ে, যতটা সম্ভব। শেষমেশ লোহার পাত গলে একটু ফাঁকা হলো—যথেষ্ট একজন মানুষ বের হওয়ার মতো। সেই সুযোগেই একজন-একজন করে বের হতে থাকল। গেটের পাশে একটি আমগাছ ছিল, ছাত্ররা সেটি ধরে নিচে নেমে গেল।

মোট সময়? তিন মিনিট মাত্র! কিন্তু সেই তিন মিনিটেই যেন জীবন ও মৃত্যুর পার্থক্য তৈরি হলো।

নিচে নেমে তখনো সায়েদুল আমীন বুঝতে পারেননি কী ঘটেছে। বিস্ফোরণের শব্দ, আগুন, ধোঁয়া—সব কিছু একসাথে মাথায় ঘুরছিল। পরে জানতে পারলেন, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান ভবনটির সিঁড়ির মুখে এসে বিধ্বস্ত হয়েছে। আগুন সেখান থেকেই ছড়িয়েছে। নিচতলার বাংলা ভার্সন ক্লাসগুলোতে আগুন প্রথম পৌঁছায়, এরপর ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে।

ততক্ষণে স্কুলের ভেতরে ঝরে পড়েছে প্রাণ। অনেক শিশু আগুনে পুড়ে মারা গেছে, কেউ হাসপাতালের শয্যায় কাতরাচ্ছে। সহকর্মী শিক্ষকদের মধ্যেও কেউ কেউ মারা গেছেন। এই দৃশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে কাঁপছেন সায়েদুল আমীন। তিনি বলেন, “এমন দিন কোনো দিন কল্পনাও করিনি। যে ফুলগুলো ঝরে গেছে, তারা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।”

তবে তিনি স্বস্তি পান এই ভেবে যে, তাঁর সঙ্গে থাকা ছাত্ররা সবাই বের হতে পেরেছে। কেউ সামান্য দগ্ধ, কেউ ধোঁয়ার কারণে শ্বাসকষ্টে ভুগছে, কিন্তু সবাই বেঁচে আছে। গায়ে আগুন নিয়ে আসা সেই ছেলেটিও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তবে বেঁচে গেছে।

তিনি বলেন, “আর দু-এক মিনিট দেরি হলেই হয়তো কেউই বাঁচতে পারত না। যে আগুন আর তাপ আমরা দেখেছি, তা কোনো শব্দে বোঝানো যাবে না। আমি শুধু বলব, সৃষ্টিকর্তা যেন এই বেঁচে যাওয়াদের নতুন জীবন দেন। আর যারা চলে গেছে, তাদের শান্তি দিন।”