বাংলাদেশের বাণিজ্য মাস্টারপ্ল্যান: আমেরিকার শুল্কের জবাবে আমদানিতে ছাড়!

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য আলোচনা: শুল্ক বৃদ্ধি ও আমদানি পরিকল্পনা নিয়ে চলছে তৎপরতা

বিশ্ব ডেস্ক: বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করতে এবং পারস্পরিক শুল্ক বাধা কমাতে তৃতীয় দফা আলোচনার প্রস্তুতি চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বাংলাদেশসহ ১৪টি দেশের পণ্যের ওপর ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, যা বাংলাদেশের রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

এর আগে এপ্রিলে ঘোষিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল। এই শুল্কের ফলে বাংলাদেশের পণ্যে মোট শুল্ক ৫০ শতাংশ ছাড়াতে পারে, যা রপ্তানি প্রতিযোগিতায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশের কৌশল : আমদানি বৃদ্ধি ও শুল্ক হ্রাস

বাংলাদেশ সরকার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি আমদানিযোগ্য পণ্যের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। এর মধ্যে গম, তুলা, ভোজ্য তেল, এলএনজি এবং উড়োজাহাজের যন্ত্রাংশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এছাড়া, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ১০০টি মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক ছাড় দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানিকৃত পণ্যে গড়ে ৬ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হলেও, এটি আরও কমানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে। এই উদ্যোগের লক্ষ্য বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং পারস্পরিক বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষা করা।

২০২৪ সালে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ১০.৬ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮.৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং ২.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এই ঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ সরকার কৌশলগতভাবে মার্কিন পণ্য আমদানি বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছে।

আলোচনার অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ

দ্বিতীয় দফার আলোচনা গত ১০-১২ জুলাই ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ তৈয়বও এতে অংশ নিয়েছেন। তবে কিছু বিষয় এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রস্তাবিত চুক্তির খসড়া পাঠিয়েছে, যাতে কিছু শর্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চর্চার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে ঢাকা মনে করছে। এই বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অবস্থান চূড়ান্ত করছে।

বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা চেয়েছে, এবং বাংলাদেশও পাল্টা শুল্ক কমানোর বিষয়ে আলোচনা করছে। তিনি আশাবাদী যে আগামী বৈঠকে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা মনে করছেন, শুল্ক বৃদ্ধি বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, শুধু আমদানি বাড়িয়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব নয়। তিনি আরও সময় নিয়ে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন।

এদিকে, বিশ্লেষক ইমরান আহম্মেদ মনে করেন, বাংলাদেশ যদি মার্কিন পণ্যে শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রও পাল্টা শুল্ক কমাতে পারে, যা একটি ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্য পরিস্থিতি তৈরি করবে।

বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, ভারত ও ভিয়েতনামের তুলনায় বাংলাদেশের শুল্ক হার যদি কমানো যায়, তাহলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা সম্ভব হবে। তিনি সরকারের আলোচনার প্রচেষ্টার প্রশংসা করলেও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলের যুক্তরাষ্ট্র সফরের বিষয়ে আরও তথ্য প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন।

চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারে। চীনা পণ্যে ১০৪ শতাংশ শুল্ক আরোপের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগ বাড়তে পারে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য বাংলাদেশের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সরকার আশাবাদী যে আলোচনার মাধ্যমে শুল্ক ইস্যুতে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা রক্ষায় সংবেদনশীল।

তবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অস্থিরতা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর নীতির কারণে বাংলাদেশকে কৌশলগত এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। আগামী সপ্তাহে তৃতীয় দফা আলোচনার সময়সূচি চূড়ান্ত হওয়ার কথা রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ একটি ইতিবাচক ফলাফলের আশা করছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। শুল্ক বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার আমদানি বৃদ্ধি, শুল্ক হ্রাস এবং কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করছে। তবে, দীর্ঘমেয়াদে রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ এবং উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখতে হবে।