আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডে কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে

১৬ জুলাই ২০২৪ রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ। ছবি : তথ্য মন্ত্রণালয়

আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ডে দেশজুড়ে গণবিস্ফোরণ: কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে

টুইট প্রতিবেদন: এক বছর আগে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই, রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ।

এই নির্মম হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে ছাত্র ও সাধারণ মানুষের মাঝে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয় এবং কোটা সংস্কার দাবিতে চলমান ছাত্র আন্দোলনকে ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানে রূপান্তরিত করে।

আবু সাঈদ আন্দোলনের দিনে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। বিকেলে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও লাঠিচার্জ শুরু করলে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তখন সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানান। মাত্র ১৫ মিটার দূর থেকে দুই পুলিশ সদস্য শটগান থেকে তার শরীরে গুলি চালায়। এই হৃদয়বিদারক মুহূর্তের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং তা মুহূর্তেই জনতার ক্ষোভকে তীব্র করে তোলে।

ফাইল ছবি

নিহতদের তালিকা ও সংঘর্ষ

ওই দিনের ঘটনায় শুধু রংপুরেই নয়, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্রলীগ ও পুলিশের হামলায় অন্তত ছয়জন নিহত হন।
ঢাকায় সায়েন্সল্যাব ও ঢাকা কলেজ এলাকায় সংঘর্ষে নিহত হন হকার মো. শাহজাহান (২৪) ও নীলফামারীর যুবক সাবুজ আলী (২৫)।

চট্টগ্রামে নিহত হন তিনজন— চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ওয়াসিম আকরাম, এমইএস কলেজের শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ এবং ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী মো. ফারুক।

১৬ জুলাই দেশজুড়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। ঢাকার যাত্রাবাড়ী, শান্তিনগর, সায়েন্সল্যাব, উত্তরা, বাড্ডা, মতিঝিল, মহাখালী, প্রগতি সরণি, মিরপুর-১০, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রধান সড়ক অবরোধ করা হয়।

মহাখালীতে রেললাইন অবরোধ করায় ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগ ছয় ঘণ্টা বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও অন্যান্য মহাসড়কেও অবরোধ সৃষ্টি করেন।

সরকারি প্রতিক্রিয়া ও দমন

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ওই রাতেই ছয়টি জেলায় বিজিবি মোতায়েন করে এবং দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। ১৮ জুলাইয়ের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়।

সরকার কোটা বহাল সংক্রান্ত হাইকোর্ট রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে, যেখানে বলা হয়, কোটা রাখা বা না রাখার বিষয়টি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত, এতে আদালতের হস্তক্ষেপ অপ্রয়োজনীয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান এবং ছাত্রদল আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ তার ইউনিট নেতাকর্মীদের নিজ নিজ অফিসে অবস্থানের নির্দেশ দেয় এবং আন্দোলনের ‘রাজনৈতিক মোকাবিলা’র হুমকি দেয়।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, টিআইবি, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন, সুজনসহ পাঁচটি সংগঠন পৃথক বিবৃতিতে সহিংসতার নিন্দা জানায়।

১১৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক ও ১৯৯০ সালের ডাকসু ও সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের নেতারাও প্রতিবাদ জানান এবং শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবির পক্ষে অবস্থান নেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতৃবৃন্দ হাসনাত আবদুল্লাহ ও আসিফ মাহমুদ ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

আবু সাঈদের রক্ত সেই দিন শুধু একটি ছাত্রের মৃত্যু ছিল না—তা হয়ে ওঠে গণআন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। আজকের দিনে জাতি স্মরণ করছে সেই রক্তাক্ত অধ্যায়, যে অধ্যায় বদলে দেয় আন্দোলনের ধারা এবং নতুন বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্নের পথে এক ঐতিহাসিক বাঁক তৈরি করে।