সায়মা ওয়াজেদ দুর্নীতির অভিযোগে ডব্লিউএইচও থেকে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে

দায়িত্বহীনতা, স্বজনপ্রীতি ও জালিয়াতির বিস্ফোরক অভিযোগে কাঁপছে সিয়ারো কার্যালয়।

টুইট প্রতিবেদন: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের (SEARO) পরিচালক সায়মা ওয়াজেদকে দুর্নীতি, জালিয়াতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের গুরুতর অভিযোগের প্রেক্ষিতে ২০২৫ সালের ১১ জুলাই থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।

বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (ACC) দায়ের করা একাধিক মামলায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা একাডেমিক দাবি, অনিয়মিত অর্থ সংগ্রহ এবং অবৈধ সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

ডব্লিউএইচও’র মহাপরিচালক ড. টেড্রোস অভ্যন্তরীণ এক বার্তায় সায়মার ছুটির বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং জানান, সহকারী মহাপরিচালক ড. ক্যাথারিনা বোহমে এখন থেকে সিয়ারোর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সায়মা ওয়াজেদের নেতৃত্ব, যোগ্যতা ও নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু থেকেই বিতর্কিত ছিল। তার ছুটিতে যাওয়ার ঘটনাটি WHO’র স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়ে বিশ্বজুড়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে।

সায়মা ওয়াজেদ বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা এবং শুচোনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন। বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (ACC) তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করেছে, যার প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ

১. জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য প্রদান

২০২৩ সালে সিয়ারোর আঞ্চলিক পরিচালক নির্বাচনের সময় অকৃত্রিম একাডেমিক পদ দেখিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সায়মা। তিনি বিএসএমএমইউ-তে সম্মানসূচক পদে থাকার দাবি করেন, যা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে।

আইন লঙ্ঘন: দণ্ডবিধির ৪৬৮ (জালিয়াতির উদ্দেশ্যে জালকরণ) ও ৪৭১ (জাল নথি ব্যবহার)।

২. ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থ সংগ্রহে অনিয়ম

৩৩০ মিলিয়ন টাকা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করেন, যা শুচোনা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়। অভিযোগ উঠেছে, এ অর্থ সংগ্রহে সরকারি প্রভাব ও স্বচ্ছতার অভাব ছিল।

আইন লঙ্ঘন: দণ্ডবিধির ৪২০ (প্রতারণা) ও দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা।

৩. অবৈধ সম্পত্তি অর্জন

সায়মা পূর্বাচলে ৬০ কাঠার একটি প্লট অবৈধভাবে অর্জন করেছেন, যার মধ্যে ১০ কাঠা নিয়ে মামলা হয়েছে। গুলশানে অবস্থিত একটি ফ্ল্যাট জব্দ করা হয়েছে।

ডব্লিউএইচও’র পদক্ষেপ

ছুটিতে পাঠানো ও নেতৃত্ব পরিবর্তন- ১১ জুলাই থেকে সায়মাকে ছুটিতে পাঠানো হয় এবং ড. ক্যাথারিনা বোহমে ১৫ জুলাই থেকে ভারপ্রাপ্ত সিয়ারো পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন।

সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা

WHO’র কেন্দ্রীয় দপ্তর আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর ওপর সীমিত নিয়ন্ত্রণ রাখে, তবে দুর্নীতির অভিযোগে কেন্দ্র থেকে হস্তক্ষেপ করা যায়।

বিতর্কিত নির্বাচন ও অভিজ্ঞতার অভাব

২০২৩ সালের নির্বাচনে নেপালের প্রার্থী ডা. শম্ভু আচার্যকে অপসারণের জন্য বাংলাদেশের সরকার কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সায়মার পাবলিক হেলথ অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। তিনি মূলত অটিজম সচেতনতা নিয়ে কাজ করেছেন এবং পেশাগতভাবে একজন স্কুল সাইকোলজিস্ট।

সমালোচকদের মতে: “তিনি শেখ হাসিনার মেয়ে বলেই এই পদে বসতে পেরেছেন।”

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিক্রিয়া

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে –
“সায়মার ছুটি জবাবদিহিতার পথে প্রথম পদক্ষেপ। স্থায়ী সমাধানের মাধ্যমে তার অপসারণ ও সমস্ত সুবিধা বাতিল করা উচিত।”

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে। পররাষ্ট্র ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় WHO’র সাথে সায়মা ছাড়া যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা

এক্স (সাবেক টুইটার)-এ হাজারো পোস্টে সায়মার অপসারণ দাবি উঠে এসেছে।

২৪০০ মানুষ একটি অনলাইন পিটিশনে স্বাক্ষর করেছেন।

অধ্যাপক কেন্ট বুস (মোনাশ ইউনিভার্সিটি) WHO নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার চান।

পারিবারিক পটভূমি ও রাজনৈতিক অভিঘাত

শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তার মেয়ে সায়মা দুর্নীতির মামলার মুখোমুখি ।

ভাই সাজেব ওয়াজেদ অভিযোগগুলোকে “মানহানিকর প্রচারণা” বলে উড়িয়ে দেন।

কাজিন তুলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের দুর্নীতি বিরোধী মন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

বর্তমান অবস্থান

সায়মা ওয়াজেদ বর্তমানে নয়াদিল্লিতে অবস্থান করছেন। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি আছে, ফলে দেশে ফিরতে পারছেন না।

WHO তার ভবিষ্যত বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনা WHO’র বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আঞ্চলিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে তীব্র প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।

সায়মা ওয়াজেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
ডব্লিউএইচও ও বাংলাদেশ উভয় ক্ষেত্রেই এ ঘটনা সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।

সূত্র: ফিনান্সিয়াল টাইমস, হেলথ পলিসি ওয়াচ, দ্য ডেইলি স্টার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।