ভেজাল ও নকল ওষুধে সয়লাব বাজার: জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি
টুইট প্রতিবেদন: বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে ভয়াবহ নৈরাজ্য চলছে। বাজারে প্রায় ৪০ শতাংশ ওষুধ ভেজাল ও নকল, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এই ভেজাল ও নকল ওষুধের বিস্তার বেশি।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে ৩০২টি অ্যালোপ্যাথি ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানির মধ্যে ২২৯টি নিয়মিত উৎপাদন করছে, তবে অনেক কোম্পানির উৎপাদিত ওষুধের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এই পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের নিষ্ক্রিয়তা এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের অপতৎপরতা জনস্বাস্থ্যকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
ভেজাল ওষুধের বিস্তার: একটি ভয়াবহ চিত্র
দৈনিক ইত্তেফাকের সরেজমিন তদন্তে রাজধানীর নামীদামী ওষুধ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের বিক্রেতারা জানিয়েছেন, বাজারে প্রায় ৪০ শতাংশ ওষুধ ভেজাল বা নকল। আমদানিকৃত ওষুধের মধ্যে নকল ও ভেজালের পরিমাণ বেশি, এমনকি ইনসুলিনের মতো জীবন রক্ষাকারী ওষুধও নকল করা হচ্ছে। বিক্রেতারা জানান, নকল ওষুধে কী ধরনের কেমিক্যাল বা উপাদান মেশানো হচ্ছে, তা প্রস্তুতকারীরাও স্পষ্টভাবে জানেন না। সম্প্রতি মোবাইল কোর্টের অভিযানে আটক কয়েকজন স্বীকার করেছেন, তারা শুধু প্যাকেট, রং এবং পাউডারের হুবহু নকল তৈরি করেন, কিন্তু উপাদান সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই।
ঢাকার মিটফোর্ড এলাকা, দেশের বৃহত্তম ওষুধের পাইকারি বাজার, নকল ও ভেজাল ওষুধের কেন্দ্র হিসেবে কুখ্যাত। এখান থেকে সারা দেশে ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। গোয়েন্দা পুলিশের তথ্যানুযায়ী, সাভার, পিরোজপুর, নীলফামারী এবং কুমিল্লার কাপ্তান বাজারে অবস্থিত কারখানাগুলোতে আটা, ময়দা ও বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করা হয়। এই ওষুধগুলো জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের হুবহু নকল করে বাজারজাত করা হয়, যা সাধারণ ক্রেতারা চিনতে পারেন না।
স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ভেজাল ও নকল ওষুধের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, “নকল ও ভেজাল ওষুধ সেবনে রোগীর শরীরে নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, এমনকি কিডনি, লিভার বা হার্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে।”
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কামরুল আলম জানান, চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ফার্মেসি থেকে ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ প্রয়োজন। তিনি বলেন, “যে কেউ ওষুধের নাম বললেই তা বিক্রি করা আত্মঘাতী।” কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ সতর্ক করে বলেন, “ভেজাল ওষুধে রোগ সারার পরিবর্তে উলটো জটিলতা বাড়ে, যা রোগীর অঙ্গহানির কারণ হতে পারে।”
শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. শফি আহমেদ মোয়াজ বিশেষভাবে শিশুদের জন্য ভেজাল ওষুধের ক্ষতিকর প্রভাবের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “নকল ওষুধ শিশুদের জন্য মারাত্মক হুমকি, যা জীবন রক্ষার বদলে প্রাণ কেড়ে নিতে পারে।” গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুসাররাত সুলতানা সুমি জানান, গর্ভবতী মায়েদের জন্য ভেজাল ওষুধ মা ও শিশু উভয়ের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করে।
প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও দুর্নীতির অভিযোগ
ওষুধ বিক্রেতাদের অভিযোগ, নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো নয়। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, একশ্রেণির কর্মকর্তা নকল ও ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নেন, যা এই নৈরাজ্যের পেছনে একটি বড় কারণ। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আশরাফ হোসেন স্বীকার করেন, জনবলের স্বল্পতার কারণে বিশাল ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তিনি বলেন, “চাহিদার তুলনায় আমাদের জনবল কম। তবুও ভেজাল ও নকল ওষুধের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।”
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, “নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বিপণন গণহত্যার সমতুল্য অপরাধ। যারা এই কাজে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।”
অভিযান ও শাস্তির সীমাবদ্ধতা
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাঝেমধ্যে ভেজাল ও নকল ওষুধের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। ২০১৫ সাল থেকে ড্রাগ কোর্টে ৩৬টি এবং মোবাইল কোর্টে ১,৮৭২টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া ৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা জরিমানা এবং ২৯ কোটি টাকার নকল ও ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়েছে। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অভিযানগুলো স্থায়ী সমাধান নয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “আইনের কঠোর প্রয়োগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে এই অপরাধ বন্ধ হচ্ছে না।” ২০২৩ সালে পাস হওয়া ওষুধ ও কসমেটিক আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রির জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রাখা হলেও, এর পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ এখনো দৃশ্যমান নয়।
২০০৯ সালে রিড ফার্মা নামে একটি কোম্পানির ভেজাল প্যারাসিটামল সিরাপ সেবনে ২৮ শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু তদন্তে গাফিলতির কারণে ২০১৬ সালে আদালত অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস দেন। এই ধরনের ঘটনা ভেজাল ওষুধ প্রস্তুতকারীদের আরও উৎসাহিত করছে।
ওষুধ শিল্পের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প দেশের ৯৮ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে এবং ১৫৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ডা. জাকির হোসেন বলেন, “দেশের ওষুধের আন্তর্জাতিক চাহিদা বাড়ছে, কিন্তু ভেজাল ও নকল ওষুধ এই সুনাম নষ্ট করছে।” তিনি ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ওপর জোর দেন।
অন্যদিকে, তদারকির অভাবে নিম্নমানের ওষুধের উৎপাদন ও বিপণন বেড়ে চলেছে। একবার বাজারে ওষুধ ছাড়ার পর এর গুণগত মান পরীক্ষা করা হয় না, যা অসাধু কোম্পানিগুলোর জন্য সুযোগ তৈরি করছে।
সমাধানের পথ
ভেজালবিরোধী আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, “নিয়মিত অভিযান ও কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে ভেজাল ও নকল ওষুধের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে।” তিনি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তির বিধান কার্যকর করার পরামর্শ দেন। বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাব করেছেন, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের জনবল বাড়ানো, নিয়মিত তদারকি, এবং কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব।
ভেজাল ও নকল ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। এই নৈরাজ্য বন্ধ করতে সরকার, প্রশাসন, এবং ওষুধ শিল্প সমিতির সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং কঠোর আইনি ব্যবস্থা অত্যন্ত জরুরি। নইলে, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ জীবন কেড়ে নেওয়ার হাতিয়ার হয়ে উঠবে।