চীনের সুপার ড্যাম: ভারত ও বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তার ঝুঁকি
চীনের ইয়ারলুং সাংপো সুপার ড্যাম: ভারত ও বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য প্রভাব
টুইট প্রতিবেদন: চীন তিব্বতের মেদোগ কাউন্টিতে ইয়ারলুং সাংপো নদীর উপর বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করছে, যা “সুপার ড্যাম” নামে পরিচিত। এই প্রকল্পটি চীনের ১৪তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার (২০২১-২০২৫) অংশ, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে অনুমোদিত হয়েছে।
এটি থ্রি গর্জেস ড্যামের তুলনায় তিনগুণ বেশি বিদ্যুৎ (৩০০ বিলিয়ন কিলোওয়াট-আওয়ার বা ৬০,০০০ মেগাওয়াট) উৎপাদন করবে, যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে, এই বাঁধ ভারত ও বাংলাদেশের জন্য পরিবেশগত, ভূ-রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে, কারণ ইয়ারলুং সাংপো ভারতের অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং এবং আসামে ব্রহ্মপুত্র হয়ে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশেছে।
বাঁধটি ইয়ারলুং সাংপো নদীর “গ্রেট বেন্ড” এলাকায় নির্মিত হচ্ছে, যেখানে নদীটি তিব্বত থেকে ভারতের দিকে তীব্র বাঁক নিয়ে প্রবাহিত হয়। এই অঞ্চলটি হিমালয়ের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত, যা পরিবেশগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। বাঁধটির জলাধার ৪০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধারণ করতে পারবে, যা চীনকে নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা দেবে। এই প্রকল্পটি চীনের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য অর্জনের অংশ হলেও, এটি ভারত ও বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারতের উপর প্রভাব
ইয়ারলুং সাংপো ভারতের অরুণাচল প্রদেশে সিয়াং এবং আসামে ব্রহ্মপুত্র নামে প্রবাহিত হয়। চীনের বাঁধ নির্মাণের ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ কমে যেতে পারে, যা কৃষি, পানীয় জল এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য হুমকি। বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছাড়ার ফলে অরুণাচল ও আসামে ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকি রয়েছে। অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু এই বাঁধকে “ওয়াটার বম” হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, এটি স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায় এবং জীবিকার জন্য “অস্তিত্বের হুমকি”।
ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা
বাঁধটি ভারত-চীন সীমান্তের কাছে, বিতর্কিত লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি)-এর নিকটে অবস্থিত। ভারতীয় বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, চীন এই বাঁধের মাধ্যমে পানিকে ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, বিশেষ করে সংঘাতের সময়। চীনের ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি সম্পদ ব্যবহার সংক্রান্ত কনভেনশনে স্বাক্ষর না করা এই উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
ভারত এই ঝুঁকি মোকাবিলায় অরুণাচল প্রদেশে ১১,০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সিয়াং আপার মাল্টিপারপাস প্রজেক্ট প্রস্তাব করেছে, যা পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও বন্যা প্রতিরোধে সহায়ক হবে। তবে, এই প্রকল্পটি স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরোধিতা এবং পরিবেশগত উদ্বেগের মুখোমুখি হয়েছে।
বাংলাদেশের উপর প্রভাব
ব্রহ্মপুত্র বাংলাদেশে জমুনা নামে প্রবাহিত হয়, যা দেশের কৃষি ও মৎস্যজীবীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লোয়ি ইনস্টিটিউটের মতে, নদীর প্রবাহে ৫% হ্রাসের ফলে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন ১৫% কমতে পারে, যা খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। পলি প্রবাহ হ্রাসের ফলে নদীতীরের ক্ষয় এবং সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বনের পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
পানি সংকট ও বন্যা
শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রাখলে বাংলাদেশে পানি সংকট দেখা দিতে পারে, এবং বর্ষায় অতিরিক্ত পানি ছাড়লে বন্যার ঝুঁকি বাড়বে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা ডেল্টার উপর এর প্রভাব বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। চীনের তথ্যের অস্বচ্ছতা এই ঝুঁকি মোকাবিলার প্রস্তুতিকে আরও জটিল করছে।
পরিবেশগত ঝুঁকি
ভূমিকম্পের ঝুঁকি: বাঁধটি হিমালয়ের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত। ২০২৫ সালের ৮ জানুয়ারি তিব্বতে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ১২৬ জনের মৃত্যু এই অঞ্চলের দুর্বলতা প্রকাশ করে। বাঁধ ধসে পড়লে এটি অরুণাচল, আসাম এবং বাংলাদেশে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
পলি আটকে যাওয়া- বাঁধটি পলি আটকে রাখতে পারে, যা ব্রহ্মপুত্র ডেল্টার উর্বরতা এবং সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
জলবায়ু পরিবর্তন- হিমবাহ গলন এবং নদীর তাপমাত্রার পরিবর্তন মাছ ও জলজ প্রাণীর জীবনচক্রে প্রভাব ফেলছে, যা বাঁধের কারণে আরও তীব্র হতে পারে।
চীনের দৃষ্টিকোণ
চীন দাবি করছে, এই বাঁধ পরিবেশ রক্ষার সঙ্গে নির্মিত হবে এবং নিম্নাঞ্চলের দেশগুলোর উপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। হোহাই বিশ্ববিদ্যালয় এবং চীনের পানি মন্ত্রণালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়, জ্যাংমু এবং জিয়াচা বাঁধের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ ৫০% বেড়েছে এবং বর্ষায় বন্যার চাপ কিছুটা কমেছে। তবে, চীনের মেকং নদীতে একতরফা বাঁধ নির্মাণের ইতিহাস এই দাবির উপর সন্দেহ সৃষ্টি করে।
ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব
পানি ভাগাভাগির চুক্তির অভাব: চীন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনো ত্রিপক্ষীয় পানি ভাগাভাগি চুক্তি নেই। চীনের ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের কনভেনশনে স্বাক্ষর না করা এই সমস্যাকে আরও জটিল করছে।
কৌশলগত আধিপত্য- বাঁধটি চীনকে ব্রহ্মপুত্রের উপর উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ দেবে, যা ভারত ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কৌশলগত চাপ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজন- বিশেষজ্ঞরা জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ত্রিপক্ষীয় চুক্তি এবং পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের পরামর্শ দিয়েছেন।
গবেষকরা ইয়ারলুং সাংপো নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য সমন্বিত পরিবেশগত পরিকল্পনা এবং যৌথ হাইড্রোলজিকাল গবেষণার উপর জোর দিয়েছেন। ভারত ও বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে চীনের সঙ্গে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক চুক্তি করার জন্য সক্রিয় হতে হবে। এছাড়া, চীনের কাছ থেকে প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য এবং পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়নের দাবি জোরদার করা প্রয়োজন।
ইয়ারলুং সাংপো সুপার ড্যাম চীনের নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এটি ভারত ও বাংলাদেশের জন্য পানি সংকট, বন্যা, পরিবেশগত ক্ষতি এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনার ঝুঁকি তৈরি করছে। ভারতের সিয়াং প্রকল্প এবং ত্রিপক্ষীয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এই ঝুঁকি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ। চীনের স্বচ্ছতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এই গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃসীমান্ত নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য অপরিহার্য।
তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, বিবিসি, রয়টার্স, লোয়ি ইনস্টিটিউট, ভয়েস অফ আমেরিকা, আল জাজিরা, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ইয়েল ই৩৬০, ইন্ডিয়া টুডে।