উপদেষ্টা পরিষদে উত্তরবঙ্গ উপেক্ষিত: আবু সাইদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি

#উত্তরবঙ্গের_কণ্ঠস্বর_চাই

টুইট ডেস্ক: বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ঘোষণার পরপরই দেশজুড়ে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তবে সবচেয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া উঠে এসেছে উত্তরবঙ্গ থেকে।

কারণ, ১৬ জেলার এই বিশাল ভূখণ্ড থেকে কাউকেই উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে, উত্তরবঙ্গের নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী, তরুণ ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। তারা বলছেন, এটি শুধু অবহেলা নয়—আবু সাইদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।

উত্তরবঙ্গ: অবহেলিত বাস্তবতা

উত্তরবঙ্গ বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর প্রাণশক্তির অঞ্চল। চাল, সবজি, আম, গম, ভুট্টা—সবকিছুতেই দেশকে নির্ভরতা দিয়েছে এই জনপদ। তবুও বাজেট, প্রশাসন কিংবা জাতীয় নীতিনির্ধারণী মঞ্চে উত্তরাঞ্চলের কোনো কণ্ঠস্বর নেই বললেই চলে।

“উত্তরবঙ্গের জনগণও দেশের করদাতা, দেশের নাগরিক। অথচ সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমাদের কণ্ঠস্বর নেই। এই বৈষম্য এবার বন্ধ হওয়া উচিত।”

ভয়াবহ বৈষম্য: পরিসংখ্যান যা বলে (সর্বশেষ তথ্য)

২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি): ঢাকাভিত্তিক উন্নয়ন বাস্তবায়ন ৮৫% ছাড়িয়ে গেছে, আর উত্তরাঞ্চলের গড় বাস্তবায়ন হার মাত্র ৩১%।

২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, সচিব পর্যায়ে উত্তরবঙ্গ থেকে প্রতিনিধিত্ব: ১৩৮ জন সচিবের মধ্যে মাত্র ২ জন উত্তরাঞ্চল থেকে।

চিকিৎসক অনুপাত (২০২৫): রংপুর বিভাগে প্রতি ৯,২০০ জনে মাত্র ১ জন সরকারি চিকিৎসক, যেখানে ঢাকায় এই অনুপাত ২,৪০০:১।

উপেক্ষার বাস্তব উদাহরণ:

১. রংপুর মেডিকেল কলেজে উন্নত সরঞ্জামের অভাব: দীর্ঘদিন ধরে দাবির পরও আইসিইউ ও বার্ন ইউনিট আধুনিকায়নে অগ্রগতি নেই।

বগুড়া-দিনাজপুর মহাসড়কের উন্নয়ন থেমে আছে: দুই বছর ধরে বরাদ্দ না ছাড়ায় উন্নয়ন কাজ স্থবির।

কৃষিভিত্তিক শিল্প প্রকল্প স্থবির: পাবনা, নওগাঁ ও কুড়িগ্রামে ঘোষিত একাধিক প্রকল্প এখনো মাঠে যায়নি।

বন্যা-খরার সময়ে জরুরি বরাদ্দে বৈষম্য: দক্ষিণাঞ্চলে দ্রুত বরাদ্দ হলেও উত্তরাঞ্চলে বিলম্বিত সহযোগিতা পৌঁছে।

সীমান্ত নিরাপত্তায় গাফিলতি: চাপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বারবার চুরি, গুলি ও হত্যার ঘটনা ঘটলেও স্থায়ী পদক্ষেপ অনুপস্থিত।

আবু সাইদের উত্তরবঙ্গ আজ নিঃসঙ্গ

২০২৪ সালে জাতির জন্য জীবন উৎসর্গকারী উত্তরবঙ্গের সন্তান শহীদ আবু সাইদের নাম আজ ইতিহাস বইয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পর্ষদে উত্তরবঙ্গের অনুপস্থিতি অনেকেই দেখছেন তাঁর রক্তের সাথেই বেইমানি হিসেবে।

“এটা শুধু রাজনৈতিক নয়, এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন।”

কেন এই উপেক্ষা?

বিশ্লেষকদের মতে, ঢাকাকেন্দ্রিক ক্ষমতার বলয় এবং দক্ষিণাঞ্চলভিত্তিক রাজনীতির ভারসাম্যহীনতা এর মূল কারণ।

প্রশাসনিকভাবে অনেক সময় ঢাকার বাইরে থাকা ব্যক্তিদের ‘দুর্বল সংযোগ’ ধরা হয়।

রাজধানী ও চট্টগ্রামমুখী রাজনৈতিক প্রভাবপ্রবণতা উত্তরাঞ্চলের কণ্ঠস্বরকে ঠেকিয়ে রাখছে।

উত্তরবঙ্গ থেকে দাবি:

১. উপদেষ্টা পরিষদে অন্তত দুইজন প্রতিনিধি উত্তরাঞ্চল থেকে নিয়োগ।
২. স্বতন্ত্র ‘উত্তরাঞ্চল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ গঠন করে বাজেট ও বাস্তবায়নে সরাসরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
৩. ভৌগোলিক ভারসাম্য বজায় রেখে নীতিনির্ধারণে অঞ্চলভিত্তিক কোটার নিশ্চয়তা।

ন্যায্যতা না, এটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব

উত্তরবঙ্গ শুধু রাজনৈতিক দাবি তোলে না, তারা এই দেশের উৎপাদনশীলতা, মেধা ও মানবসম্পদের গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। এই অঞ্চলকে নীতিনির্ধারণী জায়গা থেকে দূরে রাখা মানে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ভেঙে দেওয়া।

“উত্তরবঙ্গের প্রতি বারবার উপেক্ষা মানে আবু সাইদের আদর্শ ও রক্তের অপমান। এই অপমান আর সহ্য করা হবে না।” — বগুড়ার তরুণ সমাজকর্মী জহিরুল হক।

তীব্র আন্দোলনের ইঙ্গিত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতোমধ্যে #উত্তরবঙ্গের_কণ্ঠস্বর_চাই হ্যাশট্যাগে প্রচার জোরালো হয়েছে। জেলা শহরগুলোতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। নাগরিকরা বলছেন, এবার কেবল দাবি নয়, প্রয়োজনে কর্মসূচি দিয়ে রাস্তায় নামবে উত্তরবঙ্গ।

উত্তরবঙ্গকে উপদেষ্টা পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করা শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দাবি নয়—এটি ন্যায্যতা, বৈষম্য ঘোচানো এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার প্রশ্ন। অবিলম্বে এই দাবি পূরণ না হলে যে ক্ষোভ তৈরি হবে, তা রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হতে পারে।