ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে এবার স্পষ্টভাবে জড়াল যুক্তরাষ্ট্র
ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলা: ইসরায়েলি যুদ্ধের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ
বিশ্ব ডেস্ক: মধ্যপ্রাচ্য আবার উত্তপ্ত। ২১ জুন রাতে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনায় বদলে গেল সমগ্র আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির গতিপথ। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের অন্তত তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে কার্যত ইসরায়েলের পাশে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই এই সংঘাতের পূর্বাভাস মিলছিল। কিন্তু শনিবার রাতের ওই হামলা শুধু উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলেই দিল না, বরং নতুন এক সম্ভাব্য বিশ্ব সংঘাতের পথ খুলে দিল। এ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করবে হামলার পটভূমি, কৌশল, প্রতিক্রিয়া, আন্তর্জাতিক প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিণতি।
গত এক দশকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে টানাপোড়েন চরমে পৌঁছেছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিকভাবে নানা নিষেধাজ্ঞা ও চাপের মুখোমুখি হয়েছে দেশটি। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন (JCPOA)’ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৮ সালের বেরিয়ে যাওয়া এবং এরপর থেকে ইরানের কর্মসূচি পুনরায় জোরালো করা – এই দুইয়ের সংমিশ্রণে উত্তেজনার পটভূমি রচিত হয়।
ইসরায়েল বরাবরই অভিযোগ করে আসছিল যে, ইরান গোপনে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে। যদিও তেহরান এই অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করেছে এবং বলেছে যে তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে এই দ্বন্দ্ব যখন তুঙ্গে, তখন ইসরায়েল একাধিকবার হুমকি দেয়—প্রয়োজনে এককভাবেও পদক্ষেপ নেবে।
১৩ জুন ২০২৫: ইসরায়েল দাবি করে যে, তারা একটি “বিশেষ অভিযানে” ইরানের সামরিক স্থাপনার কাছে গোয়েন্দা ড্রোন পাঠিয়েছে।
১৫ জুন: ইরান এই ড্রোন ভূপাতিত করে এবং আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে।
১৭-২০ জুন: ওয়াশিংটনে ইসরায়েলি প্রতিনিধিরা ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চালিয়ে যায়।
২১ জুন রাতে: যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমান (B-2) এবং সাবমেরিন থেকে টোমাহক মিসাইল ছুড়ে ইরানের তিনটি স্থাপনায় হামলা চালানো হয়: ফরডো, নাতানজ এবং ইসফাহান।
১. ফরডো: ইরানের অন্যতম গভীর স্থাপনাগুলোর একটি। একটি পাহাড়ের নিচে এই পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্র অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্র এখানে ৩০,০০০ পাউন্ডের GBU-57A/B ‘bunker buster’ বোমা ব্যবহার করে।
২. নাতানজ: ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের কেন্দ্র। এই স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
৩. ইসফাহান: ইরানের পরমাণু জ্বালানি গবেষণা কেন্দ্র। হামলার ফলে এখানেও বড় ধরনের ধ্বংস হয়েছে বলে ইরান দাবি করেছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্য
ঘটনার পরপরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেন: “সব বিমান এখন ইরানের আকাশসীমার বাইরে। ফরডোতে সফল বোমা হামলা সম্পন্ন হয়েছে এবং বিমানগুলো নিরাপদে ফিরে এসেছে। এটি একটি সফল অপারেশন।”
তিনি আরও জানান, “আমেরিকা শান্তি চায়, তবে হুমকি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত।”
ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে জানান: “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি ইতিহাস গড়েছেন। ইরানের বিপদ থেকে কেবল ইসরায়েল নয়, গোটা বিশ্বকে রক্ষা করেছেন তিনি।”
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেন: “এটি শুধুমাত্র একটি সামরিক অভিযান নয়, এটি মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তার একটি বড় পদক্ষেপ।”
ইরানের প্রতিক্রিয়া
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হামলাকে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন বলে আখ্যা দিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান বলেছেন: “এই হামলার জন্য আমেরিকাকে চিরকাল ফল ভোগ করতে হবে।”
ইরানের সেনাবাহিনী হুঁশিয়ারি দিয়েছে, “যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যেকোনো ঘাঁটি এখন লক্ষ্যবস্তু।”
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে জানান: “এই হামলা খুবই উদ্বেগজনক। যুদ্ধ নয়, শান্তির পথেই সমস্যার সমাধান হতে হবে।”
যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া হামলার প্রেক্ষিতে উদ্বেগ জানালেও যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে।
রাশিয়া, চীন, তুরস্ক হামলার কড়া নিন্দা জানিয়েছে এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনার দাবি জানিয়েছে।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর সাময়িক নীরবতা পালন করছে। তবে আরব বিশ্বে উদ্বেগ স্পষ্ট।
সামরিক বিশ্লেষণ
এই হামলা ইঙ্গিত দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর ছায়া যুদ্ধে সীমাবদ্ধ নয়। এটি সরাসরি অংশগ্রহণ। বিশেষ করে ‘bunker buster’ বোমার ব্যবহার ইরানের সবচেয়ে গোপন ও সুরক্ষিত স্থাপনায় প্রবেশ করার সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। পাশাপাশি, B-2 স্টিলথ প্রযুক্তির মাধ্যমে ইরানের রাডার ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়া হয়েছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
১. তেল বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেল প্রতি ১৫% বেড়েছে।
২. মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসায়িক বিনিয়োগে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
৩. বিশ্ব পুঁজিবাজারে পতন শুরু হয়েছে, বিশেষত এশিয়ান ও ইউরোপীয় স্টক এক্সচেঞ্জে।
রাজনৈতিক প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রে হামলাটি কংগ্রেস অনুমতি ছাড়াই চালানো হয়েছে। ডেমোক্র্যাট দল ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ‘ওয়ার পাওয়ারস অ্যাক্ট’ লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। কংগ্রেসে ‘ইমপিচমেন্ট’ প্রস্তাবও উত্থাপন করা হয়েছে।
তবে রিপাবলিকানরা ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়েছে, বলেছে: “আমেরিকার নিরাপত্তা ও মিত্রদের রক্ষায় এটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।”
ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস
ইরান সম্ভাব্য পাল্টা হামলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেনসহ ইরানের মিত্রদের সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি ও জাহাজগুলো এখন উচ্চ সতর্কতায়। একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এড়াতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ছে।
এই হামলা শুধু একটি সামরিক অভিযান নয়, এটি ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা কাঠামোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। মধ্যপ্রাচ্য আবার একটি অজানা যাত্রায় পা রাখছে, যেখানে প্রতিক্রিয়া এবং প্রতিশোধের রাজনীতি হয়তো আরও বড় সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
পৃথিবী এখন তাকিয়ে আছে – শান্তির আলো ফিরে আসবে, না কি ছায়া নেমে আসবে বিশ্ব রাজনীতিতে?