১০ ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ ৩ লাখ কোটি টাকা

মাত্র ১০ ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ ৩ লাখ কোটি টাকা, অর্থনীতির মেরুদণ্ডে ধস

টুইট ডেস্ক: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত চরম বিপর্যয়ের মুখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।

এর মধ্যে মাত্র দশটি ব্যাংকেই জমেছে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একদিকে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের অনৈতিক ঋণ গ্রহণ, অন্যদিকে দুর্বল তদারকি ও ‘ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার’ সংস্কৃতি—সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের ভিত্তি এখন চরম ঝুঁকিতে।

শীর্ষ ১০ ব্যাংকেই ভয়াবহ অবস্থা

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটির মোট বিতরণকৃত ঋণ ৯৪ হাজার ৭৩৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৭০ হাজার ৮৫৬ কোটি টাকাই খেলাপি। খেলাপির হার ৭৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

জনতা ব্যাংকের বড় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ (প্রায় ২৪ হাজার কোটি) এবং এস আলম গ্রুপ (প্রায় ১০ হাজার কোটি)। এছাড়াও ক্রিসেন্ট লেদার, বিসমিল্লাহ ও অ্যানটেক্স গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের জালিয়াতিও এই ব্যাংকে সংঘটিত হয়েছে।

দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে। মার্চ শেষে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ৪৭ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা (২৭.৩৮%)।

তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক, যার ২৯ হাজার ৭২১ কোটি টাকার মধ্যে ৪১.৪১ শতাংশ খেলাপি। দীর্ঘদিন সিকদার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকা ন্যাশনাল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৭ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা (৬৪.০৩%)। আইএফআইসি ব্যাংকের খেলাপি ২৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা, যার ৫৮.৩৯ শতাংশই ফেরত আসছে না।

ইউনিয়ন ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, যারা এস আলম গ্রুপের প্রভাবাধীন ছিল, তাদের খেলাপি ঋণ যথাক্রমে ২৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা (৮৯.৮১%) ও ২২ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা (৩৬.৬৩%)।

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৯ হাজার ৯১ কোটি টাকা (২১.১১%)—যার মধ্যে হলমার্ক কেলেঙ্কারির বিশাল অংশ রয়েছে। রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ১৭ হাজার ১২৩ কোটি টাকা (৩৫.৬২%) এবং সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১৪ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা (৩৭.৫৮%)।

সবচেয়ে বেশি অনুপাতিক খেলাপি

অঙ্কের হিসাবে নয়, অনুপাতের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান—তাদের ১ হাজার ৩৭২ কোটি টাকার মধ্যে ৯৮.৯৬ শতাংশই খেলাপি। আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের খেলাপির হার ৯১ শতাংশ।

এছাড়া পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ৮৭.১৮%, বেসিক ব্যাংকে ৬৯.৩৪%, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ৬৭% এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে ৫৪.৩৬%।

ব্যাংকগুলোর প্রতিক্রিয়া

জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবর রহমান বলেন, “এসব ঋণ অতীতে বিতরণ করা হয়েছে। ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। ছোট ঋণ আদায়ের জন্য বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রি করা হচ্ছে এবং বড় ঋণের ক্ষেত্রে যৌথ আদায়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”

তিনি আরও জানান, গত বছরের তুলনায় আদায় ভালো এবং আমানত ১০ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।

কীভাবে এতদূর এলাম?

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। সেই তুলনায় এখন প্রায় ১৮ গুণ বেশি।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতপশিলের সুবিধা চালু হয়। পরবর্তীতে ‘ঋণ পুনর্গঠন’ ও ‘নিয়মিত দেখানোর’ সুযোগে বহু খেলাপি ঋণকে কৃত্রিমভাবে লুকিয়ে রাখা হয়। এসব সুবিধা গত বছরের ৫ আগস্ট বন্ধ হওয়ার পর প্রকৃত চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে।

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা

এই বিপুল খেলাপি ঋণের ফলে, ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকুচিত হচ্ছে, নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, আমানতকারীদের আস্থা কমছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাঝে নেতিবাচক বার্তা ছড়াচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাচ্ছে, যার বোঝা সরকারকেই বাজেটে বহন করতে হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে গোটা আর্থিক খাতই দীর্ঘমেয়াদে ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নীতিমালা। না হলে শুধু ব্যাংক নয়, পুরো অর্থনীতিই গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে।