৭৭ ফুট সুড়ঙ্গ দিয়ে পালানো সেই সুব্রত বাইন এখন সেনাবাহিনীর হেফাজতে
শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন গ্রেপ্তার: তিন দশকের অপরাধযাত্রার অবসান
টুইট প্রতিবেদন: বাংলাদেশের অপরাধ ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর অধ্যায় শেষ হলো কুখ্যাত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে। দীর্ঘ প্রায় তিন দশক ধরে যিনি দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছিলেন, সেই সুব্রত বাইন অবশেষে সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন।
ভোরের গোপন অভিযান ও গ্রেপ্তার
মঙ্গলবার (২৭ মে) ভোর ৫টা ১৫ মিনিটে কুষ্টিয়া শহরের সোনার বাংলা রোডের একটি বাড়িতে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে চালানো গোপন অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় সুব্রত বাইনকে। একই অভিযানে ধরা পড়ে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী, ‘সেভেন স্টার’ চক্রের অন্যতম নেতা মোল্লা মাসুদ ওরফে আবু রাসেল মাসুদ।
গ্রেপ্তারের পর তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে আরও দুই সহযোগী, শুটার আরাফাত ও শরীফকে আটক করা হয়। অভিযান শেষে উদ্ধার করা হয় ৫টি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গুলি এবং একটি স্যাটেলাইট ফোন।
সুব্রত বাইনের অপরাধজগতে প্রবেশ ঘটে ১৯৯১ সালে, ঢাকার আগারগাঁওয়ে জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদকে নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে। সেই ঘটনার পর তার নাম আলোচনায় আসে এবং দ্রুতই সে উঠে আসে ‘সেভেন স্টার’ নামে কুখ্যাত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর প্রধান হিসেবে।
২০০১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষিত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় তার নাম স্থান পায়। তার বিরুদ্ধে রয়েছে ৩০টিরও বেশি হত্যা মামলা। চাঁদাবাজি, অস্ত্র কারবার, অপহরণসহ নানা অপরাধে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পালিয়ে যাওয়া ও আত্মগোপন
২০০৩ সালে দেশের টানা অভিযানের মুখে ভারত পালিয়ে যায় সুব্রত। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপন করে ব্যবসা শুরু করে এবং নিজস্ব সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। তবে ২০০৮ সালে কলকাতা পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও জামিনে মুক্তি পেয়ে সে ফের আত্মগোপনে চলে যায়।
২০০৯ সালে ভারতের স্পেশাল টাস্কফোর্সের ধাওয়া খেয়ে সে নেপাল সীমান্ত অতিক্রম করে কাকরভিটা শহরে পৌঁছায়। নেপালি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে প্রথমে ভাদ্রপুর, পরে ঝুমকা কারাগারে পাঠানো হয় তাকে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম নাটকীয় জেল পালানো
২০১২ সালের ৮ নভেম্বর সুব্রত বাইন এবং আরও ১০ জন বন্দি ৭৭ ফুট লম্বা একটি সুড়ঙ্গ খুঁড়ে পালিয়ে যায়। মাত্র ২০ ইঞ্চি প্রশস্ত ও ২২ ইঞ্চি উচ্চতার সেই সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয় বাঁশ কাটার চাকু দিয়ে। তারা কারাগারের ভেতরে টুপি তৈরির কাজের আড়ালে এই সুড়ঙ্গ খনন করেছিল। এই ঘটনা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বিস্ময়কর জেল পালানোর ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়।
এরপর দীর্ঘ সময় ধরে তার অবস্থান রহস্যে ঘেরা ছিল। কখনো ভারত, কখনো নেপাল, আবার কখনো দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশে তার আত্মগোপনের খবর ছড়ায়।
সুব্রত বাইনের গ্রেপ্তার নিঃসন্দেহে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশের সমন্বিত এ অভিযানে কোনো রক্তপাত বা নাশকতা ছাড়াই এই সফলতা আসে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই গ্রেপ্তার দেশের সন্ত্রাস ও অপরাধ দমনে নতুন দিগন্তের সূচনা করল।
সুব্রত বাইনের জীবন কাহিনি কেবল একটি সন্ত্রাসীর নয়—এটি এক পটভূমি, যেখান থেকে দেশের আইন, প্রশাসন ও গোয়েন্দা ব্যবস্থার বিকাশের প্রেক্ষাপটও বোঝা যায়। তার গ্রেপ্তার এই বার্তা দেয়—যে অপরাধ যত বড়ই হোক, রাষ্ট্রের হাত থেকে কেউই চিরকাল পালিয়ে থাকতে পারে না।