হিমন্ত বিশ্ব শর্মার হুঁশিয়ারি: বাংলাদেশের দুটি ‘চিকেন নেক’ আরও সংবেদনশীল
ভারতের সিলিগুড়ি করিডরের মতো বাংলাদেশেও রয়েছে দুটি ‘চিকেন নেক’: ভৌগোলিক বাস্তবতা
এম বি আলম: ভারতের সিলিগুড়ি করিডরকে কেন্দ্র করে যখনই কোনো কৌশলগত হুমকি বা সামরিক আলোচনা সামনে আসে, তখন অনেকেই ভারতের দুর্বলতা হিসেবে এটিকে তুলে ধরেন। কিন্তু অনেকে হয়তো ভুলে যান—ঠিক তেমনি ভৌগোলিকভাবে সংবেদনশীল দুটি করিডর রয়েছে বাংলাদেশেও, যেগুলো সমান বা তার চেয়েও বেশি কৌশলগতভাবে বিপজ্জনক হতে পারে।
এই প্রতিবেদনটি কোনো রাজনৈতিক প্ররোচনার অংশ নয়, বরং একটি বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণ, যা সাম্প্রতিক সময়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার একটি আলোচিত টুইটের মাধ্যমে নতুন করে সামনে এসেছে।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মার মন্তব্য-
রবিবার (২৫ মে) আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা টুইটারে একটি বার্তা প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি বাংলাদেশের দুটি ‘চিকেন নেক’ করিডরের ভৌগোলিক দুর্বলতার দিকটি তুলে ধরেন। তার ভাষায়, “যারা নিয়মিতভাবে ভারতের ‘চিকেন নেক করিডর’ নিয়ে হুমকি দেন, তাদের জানা উচিত-বাংলাদেশের দুটি নিজস্ব ‘চিকেন নেক’ রয়েছে, যা আরও বেশি সংবেদনশীল।
১. প্রথমটি ৮০ কিমি দীর্ঘ উত্তর বাংলাদেশ করিডর—দক্ষিণ দিনাজপুর (ভারত) থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম গারো হিলস (মেঘালয়) পর্যন্ত।
২. দ্বিতীয়টি ২৮ কিমি দীর্ঘ চট্টগ্রাম করিডর—দক্ষিণ ত্রিপুরা থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত।”
তিনি আরও বলেন, এই করিডরগুলোর যেকোনো একটি ব্যাহত হলে বাংলাদেশের রংপুর বিভাগ বা চট্টগ্রাম দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।
বাংলাদেশে দুটি ‘চিকেন নেক’ করিডর: বিশ্লেষণ
১. উত্তর বাংলাদেশ করিডর – ৮০ কিমি দীর্ঘ সংকীর্ণ করিডর
এই করিডরটি দক্ষিণ দিনাজপুর (ভারত) সীমান্ত থেকে শুরু হয়ে মেঘালয়ের গারো পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত। ভৌগোলিকভাবে এটি বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের সঙ্গে বাকি অংশের একমাত্র সংযোগ পথ। এখানে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাটসহ আটটি জেলা রয়েছে, যেগুলো এই করিডরের মাধ্যমে দেশের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত।
যদি এই করিডর ব্যাহত হয় (যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে), তবে পুরো রংপুর বিভাগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
২. চট্টগ্রাম করিডর – ২৮ কিমির জীবনরেখা
দ্বিতীয় করিডরটি চট্টগ্রাম করিডর নামে পরিচিত। এটি দক্ষিণ ত্রিপুরা সীমান্ত থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত মাত্র ২৮ কিলোমিটারের এক সংকীর্ণ ভূখণ্ড। এই করিডরটি চট্টগ্রাম ও ঢাকার মধ্যে একমাত্র স্থল সংযোগ, যার মাধ্যমে পণ্য পরিবহন, সামরিক লজিস্টিক এবং আন্তর্জাতিক বন্দর সংযোগ নিশ্চিত হয়।
এই করিডর যদি ব্যাহত হয়, চট্টগ্রাম কার্যত দেশের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এর প্রভাব পড়বে অর্থনীতি, শিল্প, আমদানি-রপ্তানি এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থায়।
ভারতের সিলিগুড়ি করিডরের তুলনা
সিলিগুড়ি করিডর, যাকে “চিকেন নেক” বলা হয়, এটি ভারতের মূল ভূখণ্ডকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত রাখে। এটি প্রায় ২২-২৫ কিমি চওড়া এবং ২০০ কিমি দীর্ঘ। এর একদিকে নেপাল, অন্যদিকে বাংলাদেশ। কৌশলগতভাবে এটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, ভারত এখানে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক ও অবকাঠামোগত প্রস্তুতি রেখেছে।
ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও কূটনৈতিক গুরুত্ব
এই দুটি করিডর শুধু ভৌগোলিক নয়, বরং কূটনৈতিক এবং সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস চীন সফরের সময় ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোকে বাংলাদেশের মাধ্যমে সমুদ্রপথে সংযুক্ত করার প্রসঙ্গে কথা বলেন, যা চীনের জন্য একটি অর্থনৈতিক সুযোগ হতে পারে।
এই মন্তব্যকে কেন্দ্র করে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেন, এটি “অপমানজনক ও নিন্দনীয়” এবং বাংলাদেশ নিজের ভৌগোলিক বাস্তবতা ভুলে গিয়ে ভারতের দুর্বলতা নিয়ে কথা বলছে।
ভূগোল কখনও একমুখী নয়। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত যেমন তার সিলিগুড়ি করিডর নিয়ে সচেতন, তেমনি বাংলাদেশেরও উচিত তার দুটি গুরুত্বপূর্ণ করিডর—উত্তর বাংলাদেশ করিডর ও চট্টগ্রাম করিডর—নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা।
ভৌগোলিক সংবেদনশীলতা কেবল মানচিত্রের রেখায় সীমাবদ্ধ নয়; এটি জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং বৈদেশিক নীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এখানে বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত যেমন তার সিলিগুড়ি করিডরের কৌশলগত গুরুত্ব ও ঝুঁকি সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন, তেমনি বাংলাদেশও নিজের ভূখণ্ডের করিডরগুলোর ভৌগোলিক সংবেদনশীলতা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ও সতর্ক।
তবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও কূটনৈতিক ভারসাম্যের মধ্য দিয়েই দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব।