শেখ হাসিনার শেষ ক্ষোভ: ট্রাইব্যুনালে উঠে এলো ৫ আগস্টের গোপন ইতিহাস

শেখ রেহানার পা ধরা ও শেখ হাসিনার বিদায়: ট্রাইব্যুনালে উঠে এলো ৫ আগস্টের গোপন ইতিহাস

টুইট প্রতিবেদক: বাংলাদেশের ইতিহাসে নাটকীয় ও রক্তাক্ত মোড় নেওয়া ৫ আগস্টের ঘটনা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনালের সামনে উপস্থাপিত এক তদন্ত প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ছাত্র-জনতার বিশাল বিক্ষোভের মুখে যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানাচ্ছিলেন, তখন তার ছোট বোন শেখ রেহানা তার পা ধরে পদত্যাগের অনুরোধ জানান।

রোববার (২৫ মে) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এই বিস্ফোরক তথ্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, ঢাকার রাজপথে উত্তাল জনতা গণভবন অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিল ৫ আগস্ট সকালে। সেসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চূড়ান্ত পর্যায়ের বলপ্রয়োগে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে চাইছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বোন শেখ রেহানার আবেগঘন অনুরোধে ও আন্তর্জাতিক চাপে পদত্যাগে বাধ্য হন।

শেষ মুহূর্তের উত্তেজনা ও বিভ্রান্তি

চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্য অনুযায়ী, ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে তিন বাহিনীর প্রধান ও পুলিশের আইজিপিকে তলব করেন।

তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘ব্যর্থতায়’ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আন্দোলনকারীরা সাঁজোয়া যান দখল করে লাল রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে, সামরিক যানেও উঠে পড়ছে, অথচ তোমরা কিছু করছ না!”

তিনি কর্মকর্তাদের ‍উপরে বিশ্বাস করে দায়িত্ব দেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলেন। তবে শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, সামরিক বা পুলিশি বল প্রয়োগ করে পরিস্থিতি আর নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়।

এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানার সঙ্গে কর্মকর্তারা আলাদা করে বৈঠক করেন। তারা তাকে বোঝান যে দেশের পরিস্থিতি স্নায়ুযুদ্ধের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এরপর শেখ রেহানা নিজেই শেখ হাসিনার কক্ষে যান এবং তার পা ধরে পদত্যাগের অনুরোধ জানান।

সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভূমিকা

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনাকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়ে শীর্ষ এক কর্মকর্তা বিদেশে থাকা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। জয় তার মাকে ফোনে বোঝানোর চেষ্টা করেন।

এই ঘটনার পর শেখ হাসিনা পদত্যাগে সম্মত হন, তবে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ রেকর্ড করতে চান। কিন্তু তখন গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়, শাহবাগ ও উত্তরা থেকে কয়েক লাখ জনতা গণভবনের দিকে এগিয়ে আসছে, যা ৪৫ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছাতে পারে। এই অবস্থায় ভাষণ রেকর্ডের অনুমতি না দিয়ে তাকে দ্রুত গণভবন ছাড়তে বলা হয়।

হেলিকপ্টারে বিদায়

সবশেষে, শেখ হাসিনা ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে যান।
সেখানে হেলিকপ্টারে তাদের কিছু ব্যাগ তোলা হয়। পরে বঙ্গভবনে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বেলা আড়াইটায় সামরিক হেলিকপ্টারে ভারত অভিমুখে দেশত্যাগ করেন।

৫ আগস্টের আগের রাতেই বহু উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক নেতা তাকে সেনাবাহিনীর কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তা নাকচ করে দেন এবং কারফিউ আরও কঠোর করার নির্দেশ দেন।

তবে সকাল থেকেই আন্দোলনকারীরা সেসব উপেক্ষা করে ঢাকার রাস্তায় নেমে আসেন। পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

বিচার ও ট্রাইব্যুনালের গুরুত্ব

এইসব তথ্য উঠে এসেছে চানখারপুল গণহত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদনের অংশ হিসেবে, যেখানে বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ফলে বহু ছাত্র ও নাগরিক নিহত হয়।

ট্রাইব্যুনাল বলেছে, এই ঘটনায় শেখ হাসিনার ভূমিকা এবং দায়িত্ব নির্ধারণে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত ও বিচার প্রয়োজন।

৫ আগস্ট ২০২৪ ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক টার্নিং পয়েন্ট। এদিন শেখ হাসিনার প্রস্থান কেবল একটি সরকারের পতন নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণপ্রতিরোধের শক্তিশালী বার্তা হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

শেখ রেহানার আবেগঘন ভূমিকা ও শেখ হাসিনার শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্ত এখন জাতীয় বিতর্কের কেন্দ্রে।