তার্কিশ এয়ারলাইন্সে: বার্ড হিট সন্দেহ, বেঁচে গেল ২৮০ যাত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ মঙ্গলবার (২০ মে) সকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক বড় দুর্ঘটনা থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন তার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটের ২৮০ আরোহী। উড্ডয়নের পরপরই TK713 ফ্লাইটের এক ইঞ্জিনে আগুন দেখা দিলে, পাইলট দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে জরুরি অবতরণ করেন।
ফ্লাইট TK713 (এয়ারবাস A330-303), বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টায় ঢাকা থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। মাত্র ১৫ মিনিটের মাথায়, ফ্লাইটটি যখন ঢাকার আকাশসীমা পার হচ্ছিল, তখন পাইলট একটি ইঞ্জিনে স্পার্ক বা আগুনের ঝলক দেখতে পান। বিমানটিতে দুইটি ইঞ্জিন থাকলেও একটিতে এমন আগুন লাগা যেকোনো ফ্লাইটের জন্য গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করে।
পাইলটের বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত
পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে পাইলট সিদ্ধান্ত নেন অবিলম্বে ফিরে এসে বিমানটি জরুরি অবতরণ করাতে হবে। কিন্তু সরাসরি অবতরণ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে তিনি আকাশে কিছুক্ষণ চক্কর দিয়ে জ্বালানি খরচ করেন, যাতে বিমানটি ল্যান্ডিংয়ের উপযোগী হয়। সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে প্লেনটি নিরাপদে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। যাত্রীদের মধ্যে কেউ আহত হননি।
ইঞ্জিনে মিলল মৃত পাখি
বিমানবন্দরের ইঞ্জিনিয়ারিং টিম জরুরি অবতরণের পরপরই বিমানটি পরীক্ষা করে দেখে। পরিদর্শনের সময় ইঞ্জিনের ভেতরে একটি মৃত পাখি পাওয়া যায়। এই ঘটনাটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে, প্লেনটি ‘বার্ড হিট’-এর শিকার হয়েছিল। বার্ড হিট মানে আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় কোনো পাখি ইঞ্জিনে ঢুকে পড়া, যা ইঞ্জিন বিকল বা আগুন লাগার অন্যতম বড় কারণ হতে পারে।
কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ নিশ্চিত করেন যে, পাইলট উড্ডয়নের পরপরই ইঞ্জিনে স্পার্ক দেখতে পান এবং সঙ্গে সঙ্গে বার্ড হিটের সম্ভাবনা মূল্যায়ন করে জরুরি অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, “দুর্ঘটনা না ঘটায় আমরা ভাগ্যবান ছিলাম। এটি বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা।”
যাত্রীদের তথ্য
বিমানটিতে মোট ২৮০ জন আরোহী ছিলেন। এর মধ্যে ১৯ জন ছিলেন বিজনেস ক্লাসে, ২৫৬ জন ইকোনমি ক্লাসে, ৫ জন শিশু এবং ১১ জন ছিলেন কেবিন ক্রু। যাত্রীরা সবাই নিরাপদে ছিলেন এবং কাউকে হাসপাতালে নিতে হয়নি। তবে যাত্রীদের মধ্যে অনেকেই আতঙ্কে ছিলেন এবং নিরাপদে নামার পর ধন্যবাদ জানান পাইলট ও কেবিন ক্রুদের।
সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনা
এই ঘটনার মাত্র চার দিন আগে, ১৬ মে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটের বাম পাশের ল্যান্ডিং গিয়ারের চাকা খুলে নিচে পড়ে যায়। তবে সেই ফ্লাইটও পাইলটের দক্ষতায় নিরাপদে অবতরণ করতে সক্ষম হয়। সেদিন ফ্লাইটটিতে শিশুসহ ৭১ জন যাত্রী ছিলেন।
বার্ড হিট: একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি
বিশ্বজুড়েই বার্ড হিট বিমান চলাচলের জন্য অন্যতম বড় ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত। বিশেষ করে যেসব বিমানবন্দর শহরের আশপাশে বা পাখির অভয়ারণ্যসংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত, সেখানে বার্ড হিটের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। বাংলাদেশেও বার্ড হিট একটি গুরুতর সমস্যা, বিশেষ করে বর্ষাকালে এবং সকালের দিকে যখন পাখির চলাচল বেশি হয়।
শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকায় মাঝে মধ্যেই বার্ড হিটের ঘটনা ঘটে থাকে। বিমান চলাচলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ পাখি তাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিলেও তা সবসময় কার্যকর হয় না।
স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর
বিমান চলাচলে বার্ড হিট বা অন্য কোনো ইঞ্জিন সংক্রান্ত জটিলতার সময় এয়ারলাইন ও এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোলের মধ্যে সমন্বয়ের ভিত্তিতে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (SOP) অনুসরণ করা হয়। এই SOP অনুযায়ী, পাইলট জ্বালানি খরচ করে বিমানকে হালকা করে, এরপর নির্ধারিত রানওয়ে ও ফায়ার ইউনিট প্রস্তুত রেখে অবতরণের সিদ্ধান্ত নেন।
ভবিষ্যতের করণীয়
এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বিমানবন্দর এলাকায় নিয়মিতভাবে পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা, ড্রোন নজরদারি, এবং যান্ত্রিক শব্দ বা লেজার লাইট ব্যবহারের মাধ্যমে পাখি নিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সেই সঙ্গে, ফ্লাইট টেক-অফ ও ল্যান্ডিংয়ের সময় বার্ড হিট রিস্ক কমাতে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে ফ্লাইট শিডিউল ও ট্রাফিক ফ্লো নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়েও গুরুত্বারোপ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তার্কিশ এয়ারলাইন্সের TK713 ফ্লাইটের ঘটনা আবারও প্রমাণ করল, আকাশপথে ভ্রমণ যত উন্নতই হোক না কেন, সঠিক সিদ্ধান্ত এবং পেশাদার দক্ষতার মাধ্যমে বড় বিপদ এড়ানো সম্ভব। এ ঘটনায় যাত্রীদের নিরাপদে রাখার জন্য পাইলট এবং এয়ার ট্রাফিক কর্তৃপক্ষের প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।