রাজশাহীতে আবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সমর্থকদের হুমকি, ভিডিও ভাইরাল

নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে আবারও স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তার সমর্থকদের প্রকাশ্যে হুমকি ও গালিগালিজ করেছেন নৌকার প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ। যার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।

ওই ভিডিওতে শোনা যায়, স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়াও তার সমর্থক ও বাগমারা সোনাডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকে অল্লীল ভাষায় গালাগালিজ করে। সেই সাথে নৌকার বাইরে যারা কাজ করবে তাদেরকে ‘পৃথিবী থেকে নাই করে দেয়ার হুমকী’ দেওয়া হয়েছে।

ভোটের দিন যতো ঘনিয়ে আসছে ততোই উত্তেজনা বাড়ছে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে । সাধারন জনগনের মনে আতংক দেখা দিয়েছে। জনগণ অজানা এক ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছেন।

তিন বারের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক এমপিসহ তার সমর্থকদের নিয়ে নৌকার প্রার্থীর দেয়া ওই বক্তব্য রোববার একটি ফেসবুক আইডি থেকে ভাইরাল হয়।

এনামুল হক রাজশাহী-৪ আসনের টানা তিনবারের সংসদ সদস্য। এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি দলীয় মনোনয়ন চেয়েও পাননি। দলের মনোনয়ন পেয়েছেন তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আজাদ।

অপর দিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়েও দলের হাই-কমান্ডের পরামর্শ মতে বর্তমান সংসদ সদস্য এনামুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী হয় বলে জানা গেছে । তাকে সম্প্রতি বাগমারা নির্বাচনী এলাকা হতে বের করে দেওয়ার ভিডিও সামাজিক মাধ্যেমে ভাইরাল হয়।

এছাড়া গত কয়েকদিন হতে একটি ফেসবুক ভিডিওতে শোনা যাচ্ছে, নৌকার প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে কর্মী ও সমর্থক উদ্দেশ্যে বলেন, “আমার সাথে যারা ভালো ব্যবহার করবে আমি ফেরশতা, যারা খারাপ করবে তারা পৃথিবী থেকে নাই হয়ে যাবে”। একটা কথা বললাম।

সেই সাথে সোনাডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ আজাহারুল হককে নিয়ে অশ্রীল বক্তব্য প্রদান করেন। ওই ভিডিওতে তিনি অধ্যক্ষ আজাহারুল হককে “আজাহার-মাজাহার বলে (অশ্লীল ভাষায়) গালিগালাজ করতে দেখা যায়”।

ছবি : সংগ্রহীত

তিনি আরো বলেন, “আমি আই এম দ্যা গ্রেট লিডার বাগমারা”। এনামুল হকের মতো লোককে ভুলি দিয়ে নৌকা নিয়েছি তার মানে বুঝতে হবে। “কোন আজাহার-মাজাহার এলাকায় থাকবে না কো”। “নৌকার বাইরে কথা বললে আজাহারের চেহারা চেঞ্জ হয়ে যাবে”।

“আওয়ামী লীগ করতে হবে নৌকায় ভোট দিতে হবে”। আজাহার ওই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তো, নাকি ?।

কালাম একজন কর্মীকে লক্ষ করে বলেন, আপনারে বিরোধীতা করে ওই এলাকায় থাকতে পারবে নাকো। কারণ সে আওয়ামী লীগ করে আওয়ামী লীগের ছেলেপেলের সাথে থাকতে হবে। “নৌকার ভোট করতে হবে”। ওগলা মাস্তানি থাকবে নাকো। “নৌকার বাইরে কোন মাস্তানি চলবে না”।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে নির্বাচনী কোন আচরণবিধি মানছেন না আবুল কালাম। জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তার পক্ষ থেকে তাকে শোকজ করা হয়। সম্প্রতি তিনি নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় স্বশরীরে হাজির হয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা প্রদান করেন।

ছবি: টুইট নিউজ

এলাকা সূত্রে ও  সোশ্যাল মিডিয়া সূত্রে  জানা যায়, আবুল কালাম এলাকায় রীতিমত মোড়ে মোড়ে নির্বাচনী পোষ্টার প্রদর্শন করেছেন। এমনকি তার আগাম পোস্টার প্রিন্ট করার ভিডিও এখন গণমাধ্যম ও মিডিয়ার কাছে রয়েছে। এছাড়াও নির্বাচনী গনসংযোগ, স্বতন্ত্র প্রাথীদের এলাকা থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি, ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন করে বক্তব্য, পেশী শক্তির ঘোষনা দিয়ে নির্বাচনী আচরণ বিধি অমান্য করেই চলেছেন। ফলে বাগমারা নির্বাচনী এলাকার জনমনে মধ্যে ভীতির দৃষ্টি হয়েছে ।

উল্লেখ্য, অতি সম্প্রতি নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় আবুল কালাম ক্ষমা চেয়ে মুচলেকা প্রদান করেন। তবে এখনও তিনি নির্বাচনী আচরণ বিধি ভঙ্গ করে চলেছেন। তার এমন কর্মকান্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।

নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকেই আবুল কালাম আজাদের মতো তার নিজের গড়া সমর্থক ও কর্মী নির্বাচনী আচরণ বিধি ভঙ্গ করছেন প্রতিদিন। আচরণ বিধি ভঙ্গ করায় নৌকার প্রার্থীর সমর্থক একজন চেয়ারম্যানকে শোকজ করা হয় সম্প্রতি।

এর আগে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ ২ ডিসেম্বর তাহেরপুর পৌর মিলনায়তনে এক মতবিনিময় সভায় ঘোষণা করেন তিনি নির্বাচনে জিতে এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হককে এলাকা ছাড়া করবেন। এ কারণে ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক রাজশাহীর নির্বাচনি শৃঙ্খলা কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগ দিলে আবুল কালাম আজাদকে শোকজ করা হয়।

তবে নির্বাচনি শৃঙ্খলা কমিটির কাছে ক্ষমা চেয়ে এলাকায় ফিরে পুনরায় স্বরূপে আবির্ভূত হন কালাম। তিনি এলাকার যেখানেই যাচ্ছেন সেখানেই এমপি এনামুল ও তার সমর্থক ও নেতাকর্মীকে এলাকা ছাড়া করার হুমকি দিচ্ছেন।

বিষয়গুলো নিয়ে গণমাধ্যম প্রতিনিধি আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে ব্যস্ততার কথা বলে পরে যোগাযোগ করতে বলেন।

বাগমারায় গ্রাম আদালতের এজলাসে নির্বাচনী প্রস্তুতি সভা । বক্তব্য রাখছেন ১৩ নং গোয়ালকন্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলমগীর সরকার।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছেন আবুল কালাম । এলাকায় তার রয়েছে সন্ত্রাসী বাহিনী।  কালাম আগে বাগমারার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ছিলেন। ২০০৭ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কালামকে আটক করেছিল এবং তার হেফাজত থেকে অস্ত্রও উদ্ধার হয়েছিল। ক্রসফায়ারের সময় তার পায়ে গুলিও লেগেছিল। তবে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। দীর্ঘ চিকিৎসার পর তার পায়ে এখনও সমস্যা থেকে গেছে।

বাগমারার তাহেরপুরে কালামের নিজের এলাকায় এখনো তার সন্ত্রাসীদের আধিপত্য রয়েছে। এলাকার ভোটাররা এসব কারণে শঙ্কিত। কালামের বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র মামলা চলমান রয়েছে বলে রাজশাহীর পুলিশ সুপার সাইফুর রহমান নিশ্চিত করেছেন। তবে ওই মামলাতে কালাম জামিনে আছেন। এলাকাবাসীর আরও শঙ্কা, ভোট মৌসুমে কালাম তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে মাঠে নামাতে পারেন।

২০১৬ সালে তাহেরপুরের মেয়র আবুল কালাম আজাদ বাগমারা উপজেলার আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদকে গুলি করে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আছে। সেই সময় নিরাপত্তা চেয়ে দলের উপজেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক ও নরদাশ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম সারোয়ার বাগমারা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। তিনি স্থানীয় সাংসদের ‘চামচামি’ করছেন বলে অভিযোগ তুলে ভবিষ্যতে এ ধরনের চামচামি করলে তাঁকে গুলি করে উড়িয়ে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেন। পরে ঘটনাটি গোলাম সারোয়ার দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের জানান।

কোমরে পিস্তল মুখে হুমকি, ২০১৬ সালের মে মাসে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে কোমরে পিস্তল গুঁজে সাধারণ ভোটারদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আছে। তিনি গোয়ালকান্দি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে দলের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীর পক্ষেে এক সন্ধ্যায় পথসভায় বক্তব্য দেন। কালাম বলেন, ‘আলমগীরকে যারা ভোট দেবে না, তারা যেন ৭ তারিখের (৭ মে) নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে না যায়। ভোটকেন্দ্রে গেলে তাদের হাত-পা ভেঙে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তার বক্তব্যে সেই সময় এলাকার জনগন আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়েন। পরে নির্বাচনের পুনঃতফসিল ঘোষণা করা হলে গোয়ালকান্দিতে আলমগীর হোসেন সরকারকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।

সেই সময় আলমগীরের বিরুদ্ধে জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে এবং এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, আলমগীর ও সিদ্দিকুল ইসলাম এক সভায় কথা বলছেন। আলমগীর সরকার জেএমবি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইয়ের সহযোগী ছিলেন। তাঁর বাড়িতে বসে বাংলাভাই বিভিন্ন সভা করতেন ও সাংবাদিকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। সেই আলমগীর এখন কালামের প্রথম সারির কর্মী। সম্প্রতি তিনি গ্রাম আদালত এজলাসে কালামের নির্বাচনী প্রস্তুতি সভা করেন।

২০১৬ সালের মে মাসে আবুল কালাম আজাদ কোমরে পিস্তল গুঁজে সাধারণ ভোটারদের হুমকি। ছবি: সংগ্রহীত

২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে তাহেরপুর পেঁয়াজহাটে রাত ১০টার দিকে বাগমারার সংসদ সদস্য এনামুল হকের সমর্থক আমানের (৩০) মাথায় মেয়র কালাম পিস্তলের বাঁট দিয়ে আঘাত করেন। এতে আমানের মাথা থেঁতলে যায়। সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। একমাত্র সন্তানের ওপর এ হামলার সুষ্ঠু বিচার পাননি আমানের মা।

একই বছরে গভীর রাতে তাহেরপুর পৌরসভার দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে যুবলীগের ৭ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সাধারণ সম্পাদক সোহেল রানা গুলি ছুড়ে অপহরণ করে মেয়র আবুল কালাম আজাদের বাড়িতে নিয়ে যান। এই নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। এলাকবাসী দাবী করছেন, তাদের হাতে জনগণ নিরাপদ নয়।

আচরণবিধি লঙ্ঘন বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর রিটার্নিং অফিসার বলেন, প্রতীক বরাদ্দের আগে কোনো প্রতীকে অথবা নিজের জন্য ভোট প্রচার করা নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন। কেউ এমনটা করে থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এক সময়ের সর্বহারা অধ্যুষিত রাজশাহীর বাগমারা এলাকায় পুলিশের অভিযানে চুনোপুঁটিরা ধরা পড়লেও এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে মূল হোতারা। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে পারছেন না। গত কয়েকদিন ধরে বেশ কয়েকজন পুলিশের হাতে আটক হলেও মূলহোতারা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।