আদানি বিদ্যুৎ চুক্তিতে সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি: তদন্তে দুদক
টুইট প্রতিবেদন: আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে করা বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)কে পাশ কাটিয়ে বিপুল অঙ্কের শুল্ক ও কর অব্যাহতির অভিযোগ উঠেছে। এতে প্রায় ৪০ কোটি মার্কিন ডলার, অর্থাৎ সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা সরকারের সম্ভাব্য রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
এই অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করেছে।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) বিকেলে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, “চুক্তির সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সচিব হিসেবে দায়িত্বে থাকা সাবেক মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউস এনবিআরের অনুমোদন ছাড়াই আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করেছেন। এতে শুল্ক ও কর ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে। দুদক বিষয়টি অনুসন্ধান করছে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পরবর্তীতে বিস্তারিত জানানো হবে।”
এনবিআরের অনুসন্ধান কী বলছে?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নিজস্ব তদন্ত প্রতিবেদনেও এই অভিযোগের প্রাথমিক ভিত্তি পাওয়া গেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই পর্যন্ত আদানি গ্রুপের কাছ থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের বিপরীতে ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৬৭ ডলার শুল্ক ও কর ফাঁকি দেয়া হয়েছে। চুক্তি সম্পাদনের সময় এনবিআরসহ সংশ্লিষ্ট কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন ছাড়াই শুল্ক ও কর অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি শুধু রাষ্ট্রীয় রাজস্ব হানিই নয়, বরং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও নিয়মনীতি লঙ্ঘনের একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ।
বিতর্কিত চুক্তি ও আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র
২০১৭ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে একটি ২৫ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ সরবরাহ চুক্তি করে। ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যে অবস্থিত আদানির ১,৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এই বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। দুটি ইউনিটে বিভক্ত এই কেন্দ্র থেকে প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে এবং দ্বিতীয় ইউনিট জুন মাসে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে।
বর্তমানে এই কেন্দ্র থেকে সরবরাহ করা বিদ্যুৎ বাংলাদেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ পূরণ করছে। তবে কয়লার উচ্চ মূল্য এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্রয় চুক্তির শর্তাবলী নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা ছিল।
অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপ
আদানি চুক্তি নিয়ে দেশব্যাপী বিতর্কের প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বাধীন বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় একটি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে। চুক্তির আর্থিক ও প্রশাসনিক দিক পুনর্মূল্যায়ন করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার লক্ষ্যে এই কমিটি কাজ করছে।
অন্যদিকে, সাবেক মুখ্যসচিব আহমদ কায়কাউসের ভূমিকা এবং আদানি গ্রুপকে দেওয়া কর অব্যাহতি নিয়ে বিতর্ক এখন কেন্দ্র করে দুদক ও এনবিআরের দ্বৈত তদন্ত শুরু হওয়ায় বিষয়টি আরও জটিল ও স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে।
আদানি চুক্তিকে ঘিরে ওঠা কর ফাঁকি, প্রশাসনিক লঙ্ঘন ও স্বার্থপরতা প্রশ্নে দুর্নীতি দমন কমিশনের এই অনুসন্ধান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখার প্রশ্নে এই তদন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছে।