চীন-ভারত-পাকিস্তান: উপমহাদেশের বারুদের স্তূপে আগুন, বাংলাদেশের করণীয় কী?
বদিউল আলম লিংকন: কাশ্মীর—দক্ষিণ এশিয়ার এক বিস্ফোরণক্ষম ভূখণ্ড, যার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিনের সংঘাত। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগের সময় থেকেই এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ ঝুলে আছে বিতর্ক আর রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্যে।
আজও কাশ্মীর একটি উত্তপ্ত ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু, যার প্রভাব শুধু ভারত-পাকিস্তান সীমাবদ্ধ নয়—বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা ও অর্থনীতির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে।
বিভাজনের সূচনা থেকেই দ্বন্দ্ব
১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের সময় ‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেনডেন্স অ্যাক্ট’-এ বলা হয়েছিল—কাশ্মীর তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে। কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু মহারাজা হরি সিং স্বাধীন থাকতে চাইলেও, পাকিস্তানি পশতুনদের হঠাৎ আগ্রাসনে বাধ্য হয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে শুরু হয় প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ।
যুদ্ধ শেষে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি হয় এবং গ্রহণ করা হয় ৪৭ নম্বর প্রস্তাব, যাতে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের কথা বলা হয়। কিন্তু পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার না করায় গণভোট আর বাস্তবায়িত হয়নি।
পেহেলগাম হামলার পর নতুন করে উত্তেজনা
সম্প্রতি কাশ্মীরের পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনা ফের ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ২৬ জন নিহত ও ১২ জন আহতের এই নৃশংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে আবারও উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় শুরু হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পর এমন উত্তেজনা দেখা গিয়েছিল।
চীন-ভারত-পাকিস্তান: কাশ্মীর ভাগের ত্রিমুখী বাস্তবতা
কাশ্মীরের একটি অংশ পাকিস্তানের দখলে (গিলগিট-বালতিস্তান), একটি অংশ ভারতের (জম্মু ও কাশ্মীর), আর আকসাই চিন অঞ্চলটি চীনের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান তার দখলকৃত অঞ্চল থেকে ট্রান্স-কারাকোরাম অংশটি চীনের হাতে তুলে দেয়। এই ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান আন্তর্জাতিক কূটনীতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব
কাশ্মীর ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, সৌদি আরবসহ বহু দেশ ও সংগঠন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। জাতিসংঘ এখনো গণভোটের প্রস্তাব বাস্তবায়নের আহ্বান জানালেও বাস্তবতা হলো—কাশ্মীর হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির দখলদারি খেলায় এক বড় মঞ্চ।
ভারত যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র; অন্যদিকে পাকিস্তান চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশীদার। এ পরিস্থিতি দক্ষিণ এশিয়াকে দুই শিবিরে বিভক্ত করে ফেলছে।
বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্য প্রভাব ও কূটনৈতিক করণীয়
কাশ্মীর সংকট বাংলাদেশের ওপর সরাসরি যুদ্ধ চাপিয়ে দিচ্ছে না ঠিকই, তবে এর প্রভাব গভীর ও বহুমাত্রিক:
১. অর্থনৈতিক চাপ ও বাণিজ্য বিঘ্ন:
যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থল ও নৌবন্দর ব্যবস্থাপনা ব্যাহত হতে পারে। রপ্তানি ও আমদানি খাতে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দেবে।
২. শরণার্থী সংকট:
যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় শরণার্থী ঢল নেমে বাংলাদেশে মানবিক ও নিরাপত্তা সংকট তৈরি করতে পারে।
৩. সন্ত্রাসবাদ ও নিরাপত্তা হুমকি:
কাশ্মীর ইস্যু আন্তর্জাতিক উগ্রপন্থীদের কাছে এক ‘জিহাদিক আদর্শ’ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোও এতে উসকানি পেতে পারে।
৪. কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা:
ভারত ও চীন—দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের গভীর অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। আবার পাকিস্তানের সঙ্গেও ধর্মীয় ও আঞ্চলিক বন্ধন রয়েছে। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশকে নিরপেক্ষ ও শান্তিপ্রিয় অবস্থান বজায় রেখে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
৫. SAARC কার্যকারিতা:
কাশ্মীর ইস্যু SAARC-এর কার্যক্রমে অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা কার্যকর করতে হলে বাংলাদেশকে শক্ত অবস্থানে গিয়ে উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে আনার চেষ্টা করতে হবে।
কাশ্মীর ইস্যু যতদিন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কূটনীতিতে জটিলতা সৃষ্টি করে রাখবে, ততদিন দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা কেবল কল্পনাই থাকবে। বাংলাদেশকে এই সংকটময় সময়ে সতর্ক, দূরদর্শী ও কৌশলী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে।
যুদ্ধ নয়, শান্তি—এই নীতি অনুসরণ করেই বাংলাদেশকে কাশ্মীর সংকটে নিজস্ব অবস্থান সুসংহত করতে হবে।