বাংলাদেশ-কাতার সম্পর্কের নতুন দিগন্ত

অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা ও মানবিক সহায়তায় সহযোগিতার বিস্তার

বদিউল আলম লিংকন: বাংলাদেশ ও কাতার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে সাম্প্রতিক দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও চুক্তির মাধ্যমে।

বিশেষ করে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাতারে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় যেসব উচ্চপর্যায়ের বৈঠক ও আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, সেগুলো দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং মানবিক সহায়তার গুরুত্বপূর্ণ দ্বার উন্মোচন করেছে।

কাতারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রীর সাক্ষাৎ

বুধবার (২৩ এপ্রিল) কাতারের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রী শেখ ফয়সাল বিন আল থানি দোহায় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।

বাংলাদেশের জন্য কাতারের সহযোগিতা

১. বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ) গঠন

বাংলাদেশ কাতারি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। এই অঞ্চলে শ্রমনির্ভর শিল্প, টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনের মতো খাতগুলিতে কাতারি বিনিয়োগ আকর্ষণের পরিকল্পনা রয়েছে।

২. প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ও সশস্ত্র বাহিনীর নিয়োগ

কাতারে বর্তমানে ৭২৫ জন বাংলাদেশি সেনা কর্মরত রয়েছেন। কাতার সরকার এই নিয়োগ আরও বাড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এটি শুধু কৌশলগত সম্পর্ক নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে দক্ষতা বৃদ্ধির একটি সুযোগ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

৩. শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও দক্ষতা উন্নয়ন

প্রায় ৪ লক্ষাধিক বাংলাদেশি কর্মরত আছেন কাতারে। দু’দেশের মধ্যে চলমান আলোচনা অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে আরও দক্ষ জনশক্তি পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে, যার মাধ্যমে রেমিট্যান্স বাড়বে এবং দুই দেশের সম্পর্ক আরও গভীর হবে।

৪. জ্বালানি খাতে অংশীদারিত্ব

২০২৩ সালে কাতারএনার্জি ও বাংলাদেশের পেট্রোবাংলার মধ্যে একটি ১৫ বছরের এলএনজি (তরল প্রাকৃতিক গ্যাস) সরবরাহ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটি কার্যকর হবে ২০২৬ সাল থেকে, যার আওতায় বছরে ১.৮ মিলিয়ন টন গ্যাস সরবরাহ করা হবে। এই অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে।

৫. শিক্ষা ও মানবিক উন্নয়নে কাতারের ভূমিকা

প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস কাতার ফাউন্ডেশন, কাতার চ্যারিটি এবং কাতার ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এই প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে ইতোমধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবিক সহায়তা প্রদান করছে। ভবিষ্যতে আরও বৃহৎ পরিসরে সহায়তা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি এসেছে এসব সংস্থার পক্ষ থেকে।

কূটনৈতিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

এই সকল সহযোগিতা শুধু সাময়িক সুবিধা নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে দুই দেশের কৌশলগত অংশীদারিত্ব গঠনের ভিত্তি তৈরি করছে। বাংলাদেশের শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান, জ্বালানি নিরাপত্তা ও মানবসম্পদ উন্নয়নে কাতারের ভূমিকা আগামী দিনে আরও শক্তিশালী হবে।

বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে সম্পর্ক এখন কেবল আনুষ্ঠানিকতা বা প্রথাগত কূটনীতির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। এটি রূপ নিচ্ছে প্রকৃত অংশীদারিত্বে—যেখানে দুই দেশ পরস্পরের চাহিদা ও সম্ভাবনাকে সম্মান করে এগিয়ে যেতে চায়।

এই সম্পর্ক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের পাশাপাশি বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার বার্তা বহন করছে।