কর্মস্থলে ‘তুই-তুমি’ সম্বোধন বন্ধের সুপারিশ শ্রম সংস্কার কমিশনের
নিজস্ব প্রতিবেদক: কর্মস্থলে মর্যাদাপূর্ণ, শালীন এবং সমানুভবসম্পন্ন ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে শ্রম সংস্কার কমিশন। সোমবার (২১ এপ্রিল) কমিশন তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়, যেখানে কর্মক্ষেত্রে ‘তুই-তুমি’ সম্বোধন নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।
- কর্মস্থলে ‘তুই-তুমি’ নয়, ‘আপনি’ ব্যবহার
- ‘মহিলা’ নয়, ‘নারী’ শব্দ ব্যবহার
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্মস্থলে অপমানজনক বা অসম্মানসূচক সম্বোধন যেমন ‘তুই-তুমি’ ব্যবহার না করে, ‘আপনি’ শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে একটি মর্যাদাবান ও সমান সহাবস্থানের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে, নারী বিষয়ে সম্মানজনক ভাষা প্রয়োগের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে—‘মহিলা’ শব্দ বাদ দিয়ে ‘নারী’ শব্দ ব্যবহার করতে বলা হয়েছে, যা লিঙ্গসমতার বার্তা বহন করে।
লিঙ্গসমতা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণে প্রস্তাব
- নারী, পুরুষ ও তৃতীয় লিঙ্গ – সকলের জন্য সমান অধিকার।
- পাহাড়ি ও সমতলের জনগোষ্ঠীর জন্য কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা।
কমিশনের প্রতিবেদনে নারী, পুরুষ এবং তৃতীয় লিঙ্গসহ সকল শ্রেণি-পেশার শ্রমিকদের সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ সব জনগোষ্ঠীর জন্য শ্রম নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দেওয়ার কথাও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
যৌন হয়রানি ও মাতৃত্বকালীন সুরক্ষা
- প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নীতিমালা প্রণয়ন।
- অভিযোগ গ্রহণ সেল গঠন।
- হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন।
শ্রম সংস্কার কমিশন কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে শক্তিশালী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে। এর আওতায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ নীতিমালা প্রণয়ন, অভিযোগ গ্রহণ সেল গঠন, এবং হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া, মাতৃত্বকালীন ছুটি পূর্ণ বেতনে ছয় মাসে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়েছে, যাতে নারীরা কর্মক্ষেত্রে আরও নিরাপদ ও সহনুভূতিশীল পরিবেশ পান। বিশেষভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারীদের জন্য বিশেষ সহায়তা স্কিম চালুর প্রস্তাবও উত্থাপন করেছে কমিশন।
শিশু শ্রম ও জবরদস্তিমূলক শ্রম বন্ধে কড়া অবস্থান
- আগাম দাদন ও জোরপূর্বক শ্রমে নিষেধাজ্ঞা
- শিশু শ্রম বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা
কমিশন সুপারিশ করেছে, শিশু শ্রম এবং জোরপূর্বক শ্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। আগাম দাদনসহ যেকোনো বাধ্যতামূলক শ্রমচুক্তির বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি চালানোর পরামর্শও রয়েছে প্রতিবেদনে।
সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রমিক কল্যাণে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ
আইএলও’র জীবনচক্রভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অনুসরণ করে সব শ্রমিকের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, অক্ষমতা, অসুস্থতা বা অবসরে আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করতেও কমিশন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব দিয়েছে।
বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহার
- শ্রম আদালত, ট্রাইব্যুনাল ও হাইকোর্টে বাংলা ভাষার ব্যবহার
প্রতিবেদনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশে শ্রম আদালত, আপিল ট্রাইব্যুনাল ও হাইকোর্ট পর্যন্ত সব স্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সুপারিশ করা হয়েছে। এর ফলে সাধারণ শ্রমিকদের বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রবেশাধিকারে সহায়ক পরিবেশ গড়ে উঠবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ভাষার সংস্কার সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলের প্রথম ধাপ বলে মনে করেন কমিশন। শ্রম সংস্কার কমিশনের এ প্রতিবেদন শুধু ভাষা ব্যবহারে নয়, বরং সার্বিকভাবে মানবিক, মর্যাদাসম্পন্ন ও ন্যায্য কর্মপরিবেশ গঠনের একটি রূপরেখা বলেই দেখা হচ্ছে।
যদি সরকার এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে আন্তরিক হয়, তাহলে বাংলাদেশে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত করার পথে বড় এক অগ্রগতি ঘটবে বলেই মনে করছেন শ্রম বিশ্লেষকরা।