নববর্ষ ও রাজনীতি: সময়ের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন
টুইট ডেস্ক: বাংলা নববর্ষ একটি সাংস্কৃতিক উৎসব হলেও সময়ের পরিক্রমায় এটি কখনও কখনও রাজনৈতিক প্রতীক বা প্রতিক্রিয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাঙালির জাতীয়তাবোধ, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এবং গণজাগরণের বিভিন্ন পর্যায়ে নববর্ষ একটি প্রতীকী বার্তা বহন করেছে।
পাকিস্তান আমলে যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে উর্দু ও ইসলামিক ক্যালেন্ডারকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়, তখন বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও পরিচয় সংকটে পড়ে। বাংলা নববর্ষ পালন তখন এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধে পরিণত হয়। এটি ছিল এক প্রকার প্রতিবাদ, যেখানে বাঙালিরা তাঁদের নিজস্ব সন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তাদের আলাদা অস্তিত্ব তুলে ধরেন।
এই সময়েই ছায়ানট রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু করে, যা কেবল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ছিল না—এটি ছিল রাজনৈতিক প্রতিরোধের একটি নীরব মাধ্যম। বলা হতো ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে, সাংস্কৃতিক সাম্য ও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে একটি প্রতীক।
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে নববর্ষ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর নববর্ষ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়। একটি স্বাধীন জাতির আত্মপরিচয় গঠনের জন্য এই উৎসবকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি ও উৎসাহ দেওয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের সময় থেকে শুরু করে আজ অবধি নববর্ষ বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ এক অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত।
সময় বদলেছে, রাজনীতিও পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু বাংলা নববর্ষ তার আবেদন হারায়নি। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তা শঙ্কা কিংবা ধর্মীয় মৌলবাদীদের হুমকির কারণে কিছু সময় নববর্ষ পালন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
২০১৫ সালের রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনা নববর্ষ উদযাপনকে কাঁপিয়ে দেয়। এটি ছিল একটি নিরীহ সাংস্কৃতিক উৎসবকে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ দিয়ে দমন করার চেষ্টা। তবে এরপর রাষ্ট্র ও সাধারণ মানুষ আরও বেশি করে নববর্ষ উদযাপনে অংশ নিয়েছে—যেন এটি মৌলবাদ বিরোধী চেতনাকে আরও দৃঢ় করে তুলেছে।
নববর্ষ পালনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভূমিকাও বিভিন্ন সময়ে ভিন্নরকম ছিল। একদিকে প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি নববর্ষকে জাতীয় ঐক্য, অসাম্প্রদায়িকতা ও সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে ধারণ করে উৎসাহ দিয়েছে; অন্যদিকে কিছু রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী নিজেদের ধর্মীয় ভোটব্যাংকের কারণে এ উৎসবকে পাত্তা না দিয়ে উপেক্ষা বা বিতর্কিত করতে চেয়েছে।
তবে বাস্তবতা হলো, বাংলা নববর্ষ বাঙালির হৃদয়ের উৎসব। এটি রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে বাঙালির সামষ্টিক আত্মপরিচয়ের জায়গা দখল করে নিয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসারে নববর্ষ আর শুধুই মাঠে-ময়দানে সীমাবদ্ধ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান নববর্ষ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানায়, প্রচারণা চালায়, কিছু ক্ষেত্রে এটি প্রচার যুদ্ধের হাতিয়ারও হয়ে দাঁড়ায়।
কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক পোস্টার, ব্যানার ও শুভেচ্ছাবার্তা নববর্ষের উৎসবকে অকারণভাবে রাজনৈতিক রূপ দিতেও দেখা গেছে, যা সংস্কৃতিকে ব্যবহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা হিসেবেও ব্যাখ্যা করা হয়।