ভোটের অধিকার থেকে নিরবতার যুগে! জনগণ নির্বাচন চায় না, কিছুদিন

বদিউল আলম লিংকন: ভোট—গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। একটি দেশের নাগরিকদের আশা, আকাঙ্ক্ষা, মত এবং নেতৃত্ব নির্বাচনের একমাত্র শান্তিপূর্ণ মাধ্যম। অথচ বাংলাদেশে আজ এক ধরনের নীরবতা বিরাজ করছে। সেই উত্তেজনাপূর্ণ নির্বাচনী উৎসব আজ নিস্তেজ, অনেকটা উৎসাহহীন।

অনেকের মুখে শোনা যাচ্ছে—“ভোট দিয়েও কী হয়? সবাই এক!” এ কথা শুনলে কেবল ক্ষোভ নয়, বরং এক ধরনের রাজনৈতিক ক্লান্তি অনুভব করা যায়।

গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন নয়, কিন্তু নির্বাচন গণতন্ত্রের সর্বপ্রধান রূপ। যখন মানুষ সেই প্রক্রিয়ায়ই অনাগ্রহী হয়ে পড়ে, তখন গোটা রাজনৈতিক কাঠামোই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

মূল প্রশ্ন—মানুষ কি সত্যিই নির্বাচন চায় না? নাকি তারা আস্থা হারিয়েছে রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি? আর যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে কেন? কীভাবে এই আস্থার সংকট জন্ম নিয়েছে? আবার কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব সেই আস্থা?

এক সময় দেশের মানুষ রাজনীতিকে দেখত এক মহান আদর্শ হিসেবে। রাজনীতি মানেই ছিল জনসেবা, নেতৃত্ব, ত্যাগ ও দেশপ্রেম। শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, জিয়াউর রহমান—এই নামগুলো উচ্চারিত হত প্রেরণার জায়গা থেকে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে রাজনীতির চরিত্র পাল্টেছে।

বর্তমানকালের রাজনীতি অর্থ, ক্ষমতা ও প্রভাবের খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিতে প্রবেশ মানে যেন ‘উন্নত জীবনের শর্টকাট’। জনগণের পাশে দাঁড়ানো নয়, বরং জনগণের ঘাড়ে চেপে বসার মাধ্যম হয়ে উঠেছে রাজনীতি। এতে রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা একেবারেই নষ্ট হয়েছে।

রাজনীতির এই দুর্বল চরিত্রের কারণে যখন মানুষ দেখে—

নির্বাচনের আগে রাজনীতিকরা আশ্বাস দেয়, পরে ভুলে যায়।

দুর্নীতিবাজরা মনোনয়ন পায়, আর আদর্শবানরা কোণঠাসা হয়।

নির্বাচনের ফলাফল আগেই নির্ধারিত থাকে বলে মনে হয়।

বিরোধী মতকে দমন করা হয় ভয় ও মামলা দিয়ে।

তখন সাধারণ ভোটার নিজেকে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক না ভেবে কেবল এককালীন ব্যবহৃত “ভোটযন্ত্র” হিসেবে অনুভব করে।

বিমুখতা—আপাতত না, না-চিরদিনের জন্য

“ভোট দিব না”—এই কথা এখন আর কেবল ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে বাস্তব চিন্তার প্রতিফলন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এখন এমন অনেকেই আছেন যারা রাজনীতি নিয়ে ভাবেন না, ভোট নিয়ে উৎসাহী নন, এমনকি রাজনৈতিক আলোচনাও এড়িয়ে চলেন।

এই নির্বাচন বিমুখতা কি স্থায়ী? নাকি এটি কেবল এই সময়ের জন্য একধরনের মানসিক আত্মরক্ষার পন্থা?

রাজনৈতিক ক্লান্তি: মানুষ চায় ‘বিরতি’

যেভাবে একজন শ্রমিক অতিরিক্ত পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে যায়, তেমনি জনগণও অতিরিক্ত রাজনৈতিক ‘উপলব্ধি’তে ক্লান্ত। প্রতিবার নির্বাচনের আগে আশার ফুলঝুরি, পরে হতাশার ধোঁয়া—এতে মানুষ এখন নিজেকে রক্ষা করতে চায়। তারা নির্বাচন থেকে কিছুদিন দূরে থাকতে চায়। এতে অনেকে প্রশ্ন তোলে—এটা কি গণতন্ত্র বর্জন?

না, এটি গণতন্ত্র বর্জন নয়। এটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি একধরনের প্রতিক্রিয়া। মানুষ নির্বাচন চায়, কিন্তু তারা আর প্রহসনের নির্বাচন চায় না। তারা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়, যেখানে প্রার্থী বেছে নেওয়ার বাস্তব সুযোগ থাকে।

বিরক্তির উৎস—একতরফা নির্বাচন ও অনিয়ম

বিগত কিছু নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে একতরফা অংশগ্রহণ, ভোটের আগেই ফলাফল নির্ধারিত থাকার অভিযোগ, জাল ভোট, কেন্দ্র দখল, প্রার্থীদের ওপর হামলা ও প্রতিপক্ষকে ভয়ভীতি দেখানো—এসব কারণে।

সাধারণ ভোটার মনে করে, “আমার ভোটের কী দাম আছে?” এই বোধই তাকে নির্বাচনের দিন ঘরে বসিয়ে রাখে।

নির্বাচন কমিশনের আস্থাহীনতা

নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সংস্থা হিসেবে গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ। কিন্তু বাংলাদেশে কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বারবার। পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ, বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, এবং দলীয় সরকারের ইশারায় নাচার অভিযোগে মানুষ কমিশনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থার অভাব মানেই নির্বাচনের প্রতি অনাস্থা।

রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংকট

আমাদের রাজনীতি এখন চরম দলকেন্দ্রিক। যারা বিরোধিতা করে, তারা ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা অনেকাংশেই বাধাগ্রস্ত। শিক্ষিত, দক্ষ, চিন্তাশীল নাগরিকেরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছে। ফলে জনগণও নিজেকে রাজনীতির বাইরে রাখতেই স্বস্তি পায়।

অন্তর্মুখিতা মানেই বিদায় নয়

তবে এটাও সত্য, এই বিমুখতা স্থায়ী নয়। মানুষ বা জনগণ এখন চুপচাপ, কিন্তু তারা সবসময়ই পরিবর্তনের সুযোগ খোঁজে। একদিন যখন তারা দেখবে—নির্বাচন সত্যিই নিরপেক্ষ, প্রার্থীরা যোগ্য, প্রতিশ্রুতি বাস্তব—তখন তারাই আবার রাস্তায় নামবে, লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেবে।

তাই এই নির্বাচন বিমুখতা একটি রাজনৈতিক বিরতির সময় মাত্র, এটা গণতন্ত্র থেকে মানুষের চিরতরে বিদায় নয়।