দুর্বল সালমা গ্রুপকে হাজার কোটি টাকার ঋণ দিতে তৎপর ইসলামী ব্যাংক
টুইট ডেস্ক: দেশের ব্যাংক খাতে যখন মন্দ ঋণের বোঝা দিন দিন ভারী হচ্ছে, ঠিক তখনই আর্থিকভাবে দুর্বল ও ঋণখেলাপি খ্যাত সালমা গ্রুপ-কে ১,১২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগের আয়োজন করছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি।
প্রশ্ন উঠেছে—দায়গ্রস্ত একটি প্রতিষ্ঠানকে এত বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ার পেছনে কী যুক্তি, আর কে বা কারা এই প্রক্রিয়ায় মূল ভূমিকা রাখছে?
বিপুল ঋণ, ক্ষীণ জামানত
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সালমা গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ইসলামী ব্যাংক গুলশান করপোরেট শাখা ৬০০ কোটি টাকার ফান্ডেড ও ৫২৪ কোটি টাকার নন-ফান্ডেড (এলসি) সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ জামানতের বিপরীতে যে সম্পদ দেখানো হয়েছে, তার প্রকৃত মূল্য ৪০ কোটি টাকারও কম। এমনকি কিছু সম্পত্তি ইতোমধ্যে অন্য ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা আছে। শুধু তাই নয়, নন-ফান্ডেড ঋণের বিপরীতে দাবি করা ৯৪% নগদ জামানতের উৎস নিয়েও রয়েছে সন্দেহ।
ইসলামী ব্যাংকের একাধিক বিভাগ ও শাখা এই বিনিয়োগে অনীহা প্রকাশ করলেও, তড়িঘড়ি করে বিনিয়োগের কাগজপত্র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন সদ্য বাধ্যতামূলক ছুটিতে যাওয়া ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা এবং চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, বোর্ড সভায় বিষয়টি অনুমোদনের জন্য তোলা হতে পারে।
জামানতের নামে শুভংকরের ফাঁকি
প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে রাজধানীর পূর্বাচলে ৮১ শতাংশ জমি জামানত হিসেবে দেখানো হয়েছে। তবে এর মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ জমি গ্রহণযোগ্য এবং বাকি জমির একটি অংশ সরকারি অধিগ্রহণে, আবার কিছু অংশ অন্য ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা। ইসলামী ব্যাংকের আইন বিভাগ ইতোমধ্যেই কাগজ যাচাইয়ের জন্য আইনজীবীদের কাছে পাঠিয়েছে।
একই সঙ্গে জামানতের অংশ হিসেবে স্থানীয় এলসিতে বিক্রয় করা ভাউচারও যুক্ত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে, যা ব্যাংকিং নীতিমালার পরিপন্থী।
ঋণ খেলাপির দীর্ঘ ইতিহাস
সিআইবি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সালমা গ্রুপের মেয়াদোত্তীর্ণ দায় ১,০৬৬ কোটি টাকা, যার মধ্যে শ্রেণিকৃত দায় ২২২ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক চৌধুরী মোহাম্মদ হানিফ শোয়েব এবং তাঁর স্ত্রী রীতা চৌধুরী-র নামে বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে যথাক্রমে ৫৪৯ কোটি ও ৪৩৭ কোটি টাকার ঋণ, যার একটি বড় অংশ ইতোমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ। ২০২৪ সালে রীতা চৌধুরী এক মাসের জন্য ইচ্ছাকৃত খেলাপিও ছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সালমা গ্রুপ, তাদের পরিচালক এবং গ্যারান্টার প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত ঋণ প্রায় ৯,১৫০ কোটি টাকা, যার মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ ২,৩৬৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক কর্তার ব্যাখ্যা নেই
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত এমডি ওমর ফারুক খান বলেন, “নতুন দায়িত্ব নেওয়ায় সালমা গ্রুপের ঋণ বিষয়ে বিস্তারিত জানি না।”
চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ মাসুদ ও বিদায়ী এমডি মুনিরুল মওলার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ব্যাংকের অন্যান্য ডিএমডিরাও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রশ্ন উঠছে, কার স্বার্থে?
আলোচিত এই বিনিয়োগ প্রক্রিয়া ব্যাংক খাতের আর্থিক শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। যখন দেশের মোট মন্দ ঋণ ২.৯১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, তখন এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের ঋণ দিয়ে ইসলামী ব্যাংক কী বার্তা দিচ্ছে?
ব্যাংক খাতে রাজনৈতিক প্রভাব, অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মিশ্রণে এমন অনিয়ম যেন ক্রমশই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিচ্ছে।
সময় এসেছে, এসব আর্থিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার।