ঋণ দিলো, ফেরত এলো না: মন্দ ঋণ ছাড়াল ১৭ শতাংশ
নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২৪ সাল শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, এটি ব্যাংক খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের ১৭ শতাংশেরও বেশি। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা একে ‘অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ আর অনিয়মই মূল কারণ
ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অতীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় একের পর এক ঋণ ছাড়, অনিয়মতান্ত্রিক পুনঃতফসিল এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি নমনীয় মনোভাব এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।
জনতা ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মজিবুর রহমান বলেন, “নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এক সময় মনে করা হয়েছিলো এগুলো আদায় হবে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে আদায়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, “ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে দায়িত্বহীনতা এবং দুর্বল তদারকি এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এতে ব্যাংক খাত ঝুঁকির মুখে পড়েছে।”
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অবস্থা উদ্বেগজনক
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি ব্যাংকের মোট মন্দ ঋণ ছাড়িয়ে গেছে এক লাখ কোটি টাকা।
জনতা ব্যাংক: সাড়ে ৬২ হাজার কোটি টাকা।
অগ্রণী ব্যাংক: প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংক: ১৫ হাজার কোটি টাকা।
রূপালী ব্যাংক: সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব ব্যাংকে বারবার ঋণ পুনঃতফসিল, আদালতের মাধ্যমে আদায় প্রক্রিয়া বিলম্ব, এবং কিছু ক্ষেত্রে ঋণ মওকুফের ঘটনাই ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
বেসরকারি ব্যাংকেও দুরবস্থার ছাপ
বেসরকারি খাতে থাকা ৪১টি ব্যাংকের মোট মন্দ ঋণ প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার ঘরে। তালিকায় শীর্ষে রয়েছে—
ন্যাশনাল ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), আইএফআইসি ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এসব প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক ও অদৃশ্য চাপের কারণে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ হয়েছে, যেগুলোর অনেকটিই এখন ‘অপ্রতুল জামানত’ কিংবা ‘নিষ্ক্রিয় প্রকল্পে’ আটকে গেছে।
শ্রেণীকৃত ঋণের হিসাব আরও ভয়াবহ
বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৩ লাখ কোটি টাকা। শ্রেণীকৃত ঋণ হচ্ছে সেই ঋণ, যা নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরও নিয়মিত কিস্তি বা আসল ফেরত আসেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মন্দ ঋণ শুধু ব্যাংকগুলোর ভারসাম্যপত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না, বরং পুরো আর্থিক খাতের উপর বিশ্বাসের সংকট তৈরি করে। এতে নতুন বিনিয়োগও ব্যাহত হয়।
‘ঋণখেলাপির সংস্কৃতি’ এখন প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে একটি ‘ঋণখেলাপির সংস্কৃতি’ গড়ে উঠেছে। অনেকেই পরিকল্পিতভাবে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার কৌশল হিসেবে আইনি ফাঁকফোকর ব্যবহার করছেন।
সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, “নির্বিচারে ঋণ দেওয়া, প্রয়োজনে ও অপ্রয়োজনে ঋণ পুনঃতফসিল এবং দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়াই এই অবস্থা ডেকে এনেছে। এখনই সংস্কার না আনলে ভবিষ্যতে এই খাত বড় ধরনের ধসের মুখে পড়বে।”
প্রতিকার কী?
বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ—স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ, বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রম আরও জোরদার করা, ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তি, এবং ‘উদার’ পুনঃতফসিল নীতির পুনর্বিবেচনা।
মন্দ ঋণের বোঝা কেবল ব্যাংক খাত নয়, গোটা অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি। সময় থাকতে ব্যবস্থা না নিলে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে দেশের আর্থিক খাত।