১০ ব্যাংকের ৪১ হাজার ১২৯ কোটি টাকার ঋণ ছাড়: ঋণ পুনঃপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা ও ব্যাংকিং খাতে উদ্বেগ
নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের শীর্ষ ১০টি ব্যাংক ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মোট ৪১,১২৯ কোটি টাকা পরিমাণ অগ্রহণযোগ্য ঋণ (ব্যাড লোন) ছাড় দিয়েছে, যা দেশের ব্যাংক খাতে মোট ছাড় দেওয়া ঋণের প্রায় অর্ধেক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ঋণ পুনঃপ্রাপ্তির সম্ভাবনা একেবারেই না থাকলে ব্যাংকগুলো এসব ঋণ ছাড় দেয়।
ব্যাংকিং বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ঋণ ছাড় সংক্রান্ত নীতিমালার শিথিলতার ফলে এই পরিমাণ ঋণ ছাড় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
সরকারি ব্যাংকের মধ্যে ঋণ ছাড়ের পরিমাণ:
সোনালী ব্যাংক ৮,৫৬৮ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংক ৫,৬২৭ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংক ৫,১২৬ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ২,৯৬৮.৮৯ কোটি টাকা ।
বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে ঋণ ছাড়ের পরিমাণ:
সাউথইস্ট ব্যাংক ৩,৬৬৪ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৩,১৯৭ কোটি টাকা, প্রাইম ব্যাংক ৩,১৮৪.৭৬ কোটি টাকা, সিটি ব্যাংক ৩,১৬৪.৭৯ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংক ২,৯৬২.৫০ কোটি টাকা, ব্যাংক এশিয়া ২,৬৬৪ কোটি টাকা।
২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে মোট ছাড় দেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮১,৫৭৮ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা বেশি।
বাংলাদেশে কার্যরত ৯টি বিদেশি ব্যাংক মিলে মোট ২,৩৫৩ কোটি টাকা ঋণ ছাড় দিয়েছে, যার মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক একাই ছাড় দিয়েছে প্রায় ১,১৩৯ কোটি টাকা।
২০২৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ ছাড়ের নীতিমালায় পরিবর্তন আনে। পূর্বে কোনো ঋণ ‘ব্যাড অ্যান্ড লস’ শ্রেণীতে তিন বছর থাকার পর তা ছাড় দেওয়া যেত, বর্তমানে সেটি দুই বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া, পাঁচ লাখ টাকার নিচের ঋণের ক্ষেত্রে ঋণ মামলা ছাড়াই ছাড় দেওয়া যাচ্ছে, যা পূর্বে ছিল দুই লাখ টাকা।
এ নিয়ে ব্যাংকিং খাতের বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত অবিলম্বে এই নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা, যাতে ঋণ ছাড়ের অপব্যবহার বন্ধ হয়।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, “একবার ঋণ ছাড় হয়ে গেলে বেশিরভাগ ব্যাংক পুনঃপ্রাপ্তির চেষ্টা আর কার্যকরভাবে চালায় না। ফলে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের জন্য এটি সুবিধাজনক হয়ে ওঠে।”
২০২৪ সালের শেষ নাগাদ ব্যাংক খাতে মোট অনাদায়ী ঋণের (এনপিএল) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৪৫ লাখ কোটি টাকা, যা আগের বছরের ১.৪৫ লাখ কোটি টাকার তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। বছরের চারটি প্রান্তিকে ধারাবাহিকভাবে ঋণ খেলাপি বেড়েছে।
এই ঋণ ছাড় ও খেলাপি ঋণের প্রবণতা ব্যাংকগুলোর লাভজনকতা, তারল্য ও আস্থা বিনষ্ট করছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে উচ্চ হারে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে, যা তাদের মুনাফায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে ক্রমবর্ধমান ঋণ ছাড়ের এই প্রবণতা শুধু ঋণ ব্যবস্থাপনা ও পুনঃপ্রাপ্তির দুর্বলতা নয়, বরং রাজনৈতিক প্রভাব ও সুশাসনের অভাবের প্রতিফলন।
নীতিমালার কড়াকড়ি এবং কার্যকর মনিটরিং ছাড়া পরিস্থিতি আরও নাজুক হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।