রাজশাহীতে ছুরিকাঘাত ও গণপিটুনিতে দুই মৃত্যু: মাদক আর হুমকির ভয়ানক পরিণতি

  • চায়ের দোকানে ছুরিকাঘাতে যুবক নিহত, অভিযুক্তকে গণপিটুনিতে হত্যা

নিজস্ব প্রতিবেদক (রাজশাহী): রাজশাহীর বাগমারায় হাটবারের দিনে চায়ের দোকানে ছুরিকাঘাতে এক যুবক নিহত হয়েছেন। পরে ওই ঘটনার অভিযোগে অভিযুক্ত যুবককেই উত্তেজিত জনতা পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে।

এ ঘটনায় আহত হয়েছেন ছয় পুলিশ সদস্য। পুলিশ জানিয়েছে, অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে শুক্রবার রাতে, উপজেলার ঝিকড়া ইউনিয়নের রনশিবাড়ি গ্রামে।

নিহত মাছ ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক (৩৫) ও অভিযুক্ত আমিনুল ইসলাম (২২)–দুজনেই নওগাঁর আত্রাই উপজেলার গোয়ালবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। যদিও ঘটনার স্থান পাশের রনশিবাড়ি গ্রামে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শুক্রবার (৪ এপ্রিল) বিকেলে রনশিবাড়ির হাটে মাছ বিক্রি করতে আসেন রাজ্জাক। সেখানে মাদকাসক্ত হিসেবে পরিচিত আমিনুল তাঁর কাছে টাকা চান। রাজ্জাক দেড় শ টাকা দিলেও আরও টাকা চাওয়ায় অপারগতা প্রকাশ করলে ক্ষিপ্ত হয়ে আমিনুল পাশের কামারের দোকান থেকে একটি ধারালো ছুরি নিয়ে রাজ্জাকের পেটে আঘাত করেন।

স্থানীয়রা রাজ্জাককে উদ্ধার করার চেষ্টা করলেও ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।

খুনের পর আতঙ্কিত আমিনুল দৌড়ে গিয়ে পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। স্থানীয়দের সংবাদে পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং রাত আটটা পর্যন্ত অভিযুক্তকে উদ্ধার করে থানায় নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু স্থানীয় জনতা তখন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি।

বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তৌহিদুল ইসলাম জানান, উত্তেজিত জনতা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এতে এক উপপরিদর্শক ও এক সহকারী উপপরিদর্শকসহ ছয় পুলিশ সদস্য আহত হন।

পুলিশের হস্তক্ষেপ ব্যর্থ হলে বিক্ষুব্ধ জনতা আমিনুলকে ছিনিয়ে নেয়। এরপর শুরু হয় নির্মম গণপিটুনি। অনেকেই ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন।

এক ভিডিওতে দেখা যায়, আমিনুল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “সে (রাজ্জাক) আমাকে জুমার নামাজ পড়তে দেয়নি।” জনতা তখন তাঁকে ধমক দিতে থাকে, এবং ইট-পাটকেল ও লাঠি দিয়ে নির্মমভাবে মারধর করে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, আমিনুলের মাথা থেঁতলে গেছে এবং তিনি নিথর পড়ে আছেন। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।

আদালত নয়, রাস্তায় ‘বিচার’

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমিনুল এলাকায় একজন বখাটে ও মাদকসেবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। প্রায়ই বিভিন্ন মানুষের কাছে টাকা চাইতেন এবং না পেলে গালিগালাজ ও হুমকি দিতেন। অনেকে বলছেন, “ওকে পুলিশে তুলে দিলে বিচার হতো, কিন্তু এভাবে মেরে ফেলা উচিত হয়নি।”

স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দা আবদুর রশিদ বলেন, “আমরা চেয়েছিলাম পুলিশ ওকে নিয়ে যাক, কিন্তু রাতের অন্ধকারে মানুষ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল।”

ওসি তৌহিদুল ইসলাম জানান, আমিনুল ইসলামকে হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে। পুলিশের ওপর হামলার বিষয়েও আলাদা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনার ভিডিওগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নেটিজেনদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কেউ কেউ আমিনুলের অপরাধকে কেন্দ্র করে জনতার রোষকে সমর্থন করলেও অধিকাংশই গণপিটুনিকে আইন-বহির্ভূত ও ভয়াবহ নজির হিসেবে অভিহিত করেছেন।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, “একজন অপরাধীরও বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারালে সমাজ ধ্বংসের দিকে যায়।”

এই ঘটনা শুধু দুটি প্রাণের অকাল মৃত্যু নয়, বরং আমাদের সমাজে আইনের অনুপস্থিতি, মাদকাসক্তির ভয়াবহতা, এবং বিচারবহির্ভূত ‘গণবিচার’-এর ভয়ংকর রূপকেই সামনে নিয়ে এসেছে।

আমিনুল অপরাধী ছিল কিনা, সেটা ঠিক করবার দায়িত্ব আদালতের। কিন্তু তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলার মধ্য দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠছে, তা সমাজের জন্য বড় হুমকি।