২৩টি ব্যাংকের অনিয়মিত ঋণের হার ১০% বেশি

টুইট ডেস্ক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেশের ব্যাংকিং খাতের অস্বাভাবিক ঋণ শ্রেণিকরণের হার (NPL – Non-Performing Loan) বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে।

এতে দেখা গেছে, ২৩টি ব্যাংকের অনিয়মিত ঋণের হার ১০% বা তার বেশি, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য গভীর সংকটের ইঙ্গিত বহন করছে।

শীর্ষ ৫টি ব্যাংক যাদের ঋণ শ্রেণিকরণের হার সবচেয়ে বেশি

প্রতিবেদনে দেখা যায়, কিছু ব্যাংকের অনিয়মিত ঋণের হার অত্যন্ত বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। শীর্ষ ৫টি ব্যাংক হলো—

১. ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান – ৯৮.৭০%
২. আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক – ৯০.৭২%
৩. ইউনিয়ন ব্যাংক – ৮৭.৯৮%
৪. পদ্মা ব্যাংক – ৮৬.৫৩%
৫. জনতা ব্যাংক – ৭২.০০%

প্রায় ৯৯% অনিয়মিত ঋণ নিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান কার্যত দেউলিয়া হতে চলেছে। এছাড়া আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক-এর অবস্থাও অত্যন্ত নাজুক।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর অবস্থা

বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়মিত ঋণ রয়েছে—
১. জনতা ব্যাংক – ৭২.০০%
২. বেসিক ব্যাংক – ৬৮.৫৭%
৩. বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক – ৬২.৪৯%
৪. বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক – ৪৩.৮৬%
৫. আইএফআইসি ব্যাংক – ৩৮.৪৯%
৬. অগ্রণী ব্যাংক – ৩৮.৪৬%

বিশেষ করে জনতা ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংকের অনিয়মিত ঋণের হার বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি

বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে—
১. সোশ্যাল ইসলামিক ব্যাংক – ৩৪.৭৯%
২. রূপালী ব্যাংক – ৩১.৭৩%
৩. গ্লোবাল ইসলামিক ব্যাংক – ৩০.৮৬%
৪. ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামিক ব্যাংক – ২৯.৩৩%
৫. এবি ব্যাংক – ২৫.৯৯%
৬. ইসলামি ব্যাংক বাংলাদেশ – ২১.০৮%

এই ব্যাংকগুলোর অনিয়মিত ঋণের হার ৩০% এর বেশি, যা ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে।

কৃষি ও বিশেষায়িত ব্যাংকের অবস্থা

কৃষিখাতে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মধ্যে—
১. রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক – ১৭.২৬%
২. বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক – ১৪.১১%

এছাড়া, অন্যান্য ব্যাংকের মধ্যে—
১. ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক – ১২.১১%
২. ওয়ান ব্যাংক – ১০.৫৮%
৩. ব্যাংক এশিয়া – ১০.০০%

এদের এনপিএল হার ১০% বা তার বেশি হওয়ায় এগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে।

ঋণ খেলাপি বৃদ্ধির কারণসমূহ

বিশ্লেষকদের মতে, অনিয়মিত ঋণের হার বৃদ্ধির বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যেমন—

১. ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ বৃদ্ধি:

অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধের পরিবর্তে পুনঃতফসিলের সুযোগ গ্রহণ করছে, যা এনপিএল কমার পরিবর্তে আরও বাড়াচ্ছে।

২. দুর্নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ:

রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির কারণে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।

৩. ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা:

অনেক ব্যাংক ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে যথাযথ ঝুঁকি বিশ্লেষণ না করেই ঋণ প্রদান করছে।

৪. অর্থনৈতিক মন্দা ও ব্যবসায়িক ক্ষতি:

কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে অনেক ব্যবসা ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছে।

এই পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকিং খাতের জন্য বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। সম্ভাব্য প্রভাবসমূহ—

১. ব্যাংকের তারল্য সংকট:

খেলাপি ঋণের কারণে নতুন ঋণ প্রদান কঠিন হয়ে উঠবে।

২. ব্যাংকের মুনাফা হ্রাস:

অনিয়মিত ঋণ বৃদ্ধির ফলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাতে পারেন।

৩. অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট:

এনপিএল বাড়তে থাকলে ব্যাংকিং খাতের সংকট সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

৪. কঠোর নীতি গ্রহণের প্রয়োজন:

বাংলাদেশ ব্যাংককে ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হবে।

সমাধান ও সুপারিশ

বিশেষজ্ঞদের মতে, অনিয়মিত ঋণের হার কমানোর জন্য কঠোর নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

১. ঋণ অনুমোদনে কঠোর নিয়ম ও নজরদারি বৃদ্ধি করা।

২. খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

৩. ঋণ পুনঃতফসিল নীতিমালা কঠোর করা।

৪. ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য বিশেষজ্ঞ টাস্কফোর্স গঠন করা।

বাংলাদেশ ব্যাংক যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে, তাহলে ব্যাংকিং খাতে আরও গভীর সংকট সৃষ্টি হতে পারে।

ব্যাংকিং খাতের জন্য এই প্রতিবেদন এক ধরনের সতর্কবার্তা। অনিয়মিত ঋণের হার অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তাই, সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। অন্যথায়, ব্যাংকিং খাত গভীর অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হতে পারে।