বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সংকট: দুর্বল ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ কী?
টুইট ডেস্ক: বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে কঠিন সময় পার করছে। ১১টি দুর্বল ব্যাংকের মধ্যে ৬টি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও অন্তত ৫টি এখনও তীব্র সংকটে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমানতকারীদের উচিত ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা যাচাই করে আমানত রাখা।
ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থা
নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন শুরু করে, যা ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর জানিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংক ও ইউসিবি ব্যাংক ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে। তবে কিছু ব্যাংক এখনও গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি নাজমুস সাদাত জানিয়েছেন, তাদের বেশিরভাগ শাখা ভালো অবস্থানে থাকলেও রমজানে অতিরিক্ত নগদ উত্তোলনের ফলে সংকট তৈরি হয়েছে।
রমজানে নগদ সংকট ও তারল্য সমস্যা
রমজানে কেনাকাটা ও অতিরিক্ত খরচের কারণে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তোলার চাপ বেড়েছে। ফলে বিশেষ করে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে। এসব ব্যাংক প্রতিদিন তারল্য সহায়তার জন্য আবেদন করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে না, যার ফলে গ্রাহকদের আমানত উত্তোলনে সমস্যা হচ্ছে।
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৪টি ব্যাংক সবচেয়ে বেশি সংকটে রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব ব্যাংকের আমানতের ৮০ শতাংশেরও বেশি মাত্র একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর কাছে কেন্দ্রীভূত ছিল, যা এখন উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
ব্যাংক খাতের অনিয়ম ও অর্থ লোপাটের অভিযোগ
অর্থনীতিবিদদের মতে, আগের সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাট হয়েছে। বিশেষ করে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য ব্যাংক থেকে আরও বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া, সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা এবং এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে ৩৫ হাজার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।
দুই ব্যাংকের জন্য ২,৫০০ কোটি টাকা সহায়তা
বাংলাদেশ ব্যাংক ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের জন্য ২,৫০০ কোটি টাকা সহায়তা অনুমোদন করেছে। এই টাকা নতুন করে ছাপিয়ে দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
যেসব ব্যাংকের অবস্থা এখনও নাজুক
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক এখনো চরম সংকটে রয়েছে। এসব ব্যাংকের বেশিরভাগ ঋণ গোষ্ঠীগত স্বার্থে দেওয়া হয়েছে, যা ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত।
যেসব ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াচ্ছে
অবশ্য কিছু ব্যাংক ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে—
✅ ইসলামী ব্যাংক
✅ সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল)
✅ এক্সিম ব্যাংক
✅ ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)
✅ আইএফআইসি ব্যাংক
✅ আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক
নতুন আইন: দুর্বল ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ কী?
সরকার দুর্বল ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা ও অবসায়নের জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। সংসদ না থাকায় ‘ব্যাংক রেজুলেশন অধ্যাদেশ ২০২৫’ নামে এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে, যা জুলাইয়ের মধ্যে কার্যকর হতে পারে।
নতুন আইনে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোর শেয়ার, সম্পদ ও দায় অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে। প্রয়োজনে ব্যাংকের কার্যক্রম সাময়িক স্থগিত করা বা নতুন বিনিয়োগকারী নিয়ে আসার ক্ষমতাও পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর স্পষ্টভাবে বলেছেন, সব ব্যাংক টিকে থাকতে পারবে না। বিশেষ করে যেসব ব্যাংক একক গোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত হয়েছে, সেগুলো রক্ষা করা কঠিন হবে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের দুর্বল ব্যাংকগুলোর সংকট কাটাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুশাসন, কঠোর নিয়ন্ত্রণ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্তিশালী ভূমিকা ছাড়া এই সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়। এখন দেখার বিষয়, নতুন আইন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ ব্যাংক খাতকে কতটা স্থিতিশীল করতে পারে।