বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সংকট: কারণ ও উত্তরণের পথ
বদিউল আলম লিংকন: বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে এক চরম সংকটের মুখোমুখি, যা সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঋণখেলাপি, তারল্য সংকট এবং নীতিগত দুর্বলতা এই সংকটের মূল কারণ।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য সংকট কাটানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও, সমস্যা এখনও বহুলাংশে বিদ্যমান।
সংকটের কারণ
১. ঋণখেলাপির উচ্চ হার: সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ প্রায় ১.৭৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা মোট ঋণের ১০% এর বেশি। এই ঋণের অধিকাংশই সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের বড় গ্রাহকদের হাতে কেন্দ্রীভূত।
২. তারল্য সংকট: ব্যাংকগুলোতে আমানতের তুলনায় ঋণ বিতরণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। এতে করে বাজারে নগদ টাকার অভাব দেখা দিয়েছে, যা ব্যাংকগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করছে।
৩. নীতিগত দুর্বলতা ও তদারকির অভাব: বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা কিছুটা শিথিল হওয়ায়, অনেক ব্যাংক উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ ও অনিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণ করেছে। ফলে বেশ কয়েকটি ব্যাংক তারল্য সংকটে পড়েছে।
৪. বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা: বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্দা ও ডলার সংকটের কারণে আমদানির ব্যয় বেড়ে গেছে, যা দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে এবং টাকার মান অবনতি ঘটছে।
উত্তরণের সম্ভাব্য পথ
১. শক্তিশালী তদারকি ও নীতিমালা প্রণয়ন: বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর তদারকি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের বদলে কার্যকর ঋণ পুনরুদ্ধার নীতি চালু করতে হবে।
২. সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা: ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে স্বচ্ছতা আনতে হলে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতাদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। অনিয়মের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. তারল্য সংকট নিরসনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা: কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যে ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (CRR) কমিয়ে তারল্য সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে, তবে এটি সাময়িক সমাধান মাত্র। ব্যাংকগুলোর সুদহার ব্যবস্থাপনা এবং সঞ্চয়কে উৎসাহিত করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রয়োজন।
৪. বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ: সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ে এবং ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট কমে।
৫. ডিজিটাল ব্যাংকিং ও ফিনটেকের প্রসার: আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্যাংকিং সেক্টরে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। ফিনটেক সেবা উন্নত করে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও গ্রাহকসেবা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
ব্যাংক খাতের এই সংকট শুধু ব্যাংকগুলোর নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। এটি মোকাবিলায় প্রয়োজন দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সরকার এবং বেসরকারি খাতের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই সংকট উত্তরণ সম্ভব। অন্যথায়, দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগ পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোর পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা
গত বছরের আগস্ট থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ১১টি সংকটাপন্ন ব্যাংকের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা নতুন অর্থ সরবরাহ করেছে। দুর্নীতির কারণে প্রায় ধসে পড়ার উপক্রম হওয়া এসব ব্যাংকের মধ্যে ছয়টি ইতোমধ্যে আমানতকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে।
ঘুরে দাঁড়ানো ছয়টি ব্যাংক:
ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), এক্সিম ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আইএফআইসি ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সহায়তা ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে এসব ব্যাংক এখন তারল্য সংকট কাটিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ব্যাংকগুলোর লাভজনকতা হুমকির মুখে রয়েছে।
সংকট কাটাতে ব্যর্থ পাঁচটি ব্যাংক
এখনও আমানতকারীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে চারটি এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
এ ব্যাংকগুলো হলো-বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তা বন্ধ হওয়ায় এসব ব্যাংক প্রতিদিন অর্থের জন্য আবেদন করলেও, পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। পাশাপাশি, গ্যারান্টি প্রকল্পের আওতায় অন্য কোনো ব্যাংক এখন এসব ব্যাংককে ঋণ দিতে আগ্রহী নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন উদ্যোগ
বাংলাদেশ ব্যাংক সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোর জন্য ‘ব্যাংক রেজোলিউশন আইন’ চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অকার্যকর ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা দেবে। এর আওতায় থাকবে- অস্থায়ী প্রশাসক নিয়োগ, নতুন বা বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ, ব্যর্থ ব্যাংক বিক্রির ব্যবস্থা।
ইসলামী ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ সরে যাওয়ার পর ইসলামী ব্যাংক নতুন করে ১৭ হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছে এবং গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে। পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পর গত ছয় মাসে সাড়ে ১২ লাখ নতুন অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে।
আইএফআইসি ও ইউসিবির পুনরুদ্ধার
আইএফআইসি ব্যাংক গত চার মাসে চার হাজার কোটি টাকা এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা নিট আমানত সংগ্রহ করেছে। ইউসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, ব্যাংকটি এখন আর তারল্য সংকটে নেই, তবে খেলাপি ঋণের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।
সংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ
এস আলম গ্রুপের চারটি ব্যাংক এখনও স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ পাঁচটি ব্যাংকের পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা খুবই কম বলে মনে করছে।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সংস্কার ও কঠোর নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভাব ছিল দীর্ঘদিন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সময়োপযোগী উদ্যোগ এবং নতুন আইন প্রণয়ন এ খাতকে আরও স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও স্থিতিশীল করতে পারে। তবে, ব্যর্থ ব্যাংকগুলোর পুনরুদ্ধার না হলে অর্থনীতি আরও সংকটাপন্ন হতে পারে।